
নিরাপদ সড়কের দাবীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইউনিফর্ম ও আইডি কার্ড ছাড়া কাউকে আন্দোলনে থাকতে দিবে না।এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে আমি গত কয়েকদিনের একদিনও আন্দোলনের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করিনি।কাল দুপুরে যখন জিগাতলায় হামলার ঘটনা শুনলাম,তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।ছুটে গিয়েছি আহত শিক্ষার্থীদের বের করতে,কিন্তু আন্দোলনে ঢু্কিনি।একটু পরেই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দেখতে পেলাম ছাত্র-ছাত্রীদের ধাওয়া করতে।শিক্ষার্থীরা ভয় পেয়ে উলটো দিকে দৌড় দিল,চোখের সামনে কতজনকে আহত হতে দেখলাম!আমি বিজিবি মার্কেটের সিড়িতে উঠলাম।কিন্তু কাল হয়ে দাড়ালো আমার গায়ে থাকা ঢাবির লগোযুক্ত টিশার্ট।হাতে ছিল মোবাইল।একজন ছুটে এসে গালি দিয়ে বললো,হারামজাদা ঢাবি থেকে আসছে আন্দোলন করতে!তারপর টেনে রাস্তায় নামিয়ে লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করলো।তার দেখাদেখি আরও ১৫-১৬ জন সন্ত্রাসী আমাকে বাঁশ,পাইপ,লাঠি দিয়ে মারতে থাকে। রাস্তার কোনেই দাঁড়িয়ে ছিল ৩০-৪০ জন মহাত্মা পুলিশ,যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল।আমি বারবার আন্দোলনে থাকার অভিযোগ অস্বীকার করি।কিন্তু তারা আমার ঢাবির লগোযুক্ত টিশার্ট দেখিয়ে জামাত-শিবির বলে গালি দিতে থাকে।
বগুড়ার মত বিএনপির ঘাঁটিতে আমার পরিবার তিন পুরুষ ধরে আওয়ামীলীগকে বাঁচিয়ে রেখেছে।সেই ১৯৭১ সাল থেকে জামায়াত,শিবিরের অসংখ্য নিপীড়নের শিকার হয়েছে।আওয়ামীলীগকে এই সেবা প্রদানের পরিণাম হিসেবে আজ আমাকে জামায়াত,শিবির অপবাদ নিয়ে মার খেতে হল।পারিবারিক রাজনীতির কারণেই আমি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী পড়ে বড় হয়েছি।শেখ মুজিবের উপর রচনা লিখে অনেকবার পুরষ্কার পেয়েছি।সত্যটা হলো,নিপীড়নের প্রতিবাদ করার সাহসটা আমি মুজিবের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম।ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!আজ নিজেদের মুজিবসেনা দাবী করা লোকগুলোই অন্যায়ভাবে আমাকে মারলো।
অনেক কষ্টে দৌড়ে বের হয়ে রিক্সা নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে চলে আসি,আমার হাত-পা তখন রক্তাক্ত।মাঝবয়সী এক লোক রড দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে চাইলে আমি হাত দিয়ে ঠেকিয়েছি,তখন চশমা ভেঙে গেছে। সাদা দাড়িওয়ালা বাবার বয়সী লোকটা যখন আমাকে মারছিল,আমার মনে হচ্ছিল আমার নিজের পিতাই আমাকে খুন করতে চাইছে!
প্রায় ভাঙা ফোন চালু করে সোহেল ভাইয়ের সাথে কথা বলি। সোহেল ভাই,আর রাজু ভাই দ্রুত এসে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করান।দুটা ইঞ্জেকশন নিয়ে,ওষুধ খেয়ে এক্সরে করানোর পর হঠাতই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।হাসপাতালের বেসিনে গিয়ে হড়হড় করে বমি করতে থাকি।বিকাল বেলা খবর পাই,জিগাতলায় প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে।খবর পেলাম Rakin Absar Arnob তার বন্ধুদের নিয়ে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীকে নিরাপদে বের করিয়ে এনেছে।
দুই দিন আগেও আমি বিশ্বাস করতাম না এই ছোট বাচ্চাদের উপর কেউ হামলা করতে পারে!
সন্ধ্যার দিকে আমাকে দেখতে হাসপাতালে আসে অর্নব,রিয়ন,জলিল আর দিলীপদা।অর্নব আমাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদতে থাকে। দিলীপদা কাঁদতে কাঁদতে বলছেন,এই বাচ্চা ছেলেগুলাকে এভাবে মারল!বন্ধু Tuhin Khan ‘র খবর পেলাম,সে নাকি রবীন্দ্র সরোবরে বসে কাঁদছে।কিন্তু আমি তখন কাঁদিনি।অর্ণবকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছি,এভ্রিথিং উইল বি ওকে!আমার সারা গায়ে তখন প্রচন্ড ব্যাথা।
রাতে ঘুমাতে গেলাম আড়াইটার দিকে।চোখের পাতা বন্ধ করতেই রক্তাক্ত শিক্ষার্থীদের মুখ ভেসে উঠলো। আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। সারা রাত না ঘুমিয়ে হুহু করে কাঁদলাম।প্রিয় ছোট ভাই-বোন,আমাকে ক্ষমা করে দিস।তোদের একজনকেও আমি রক্ষা করতে পারিনি।
আহারে আমার আহত ছোট্ট ভাই-বোনগুলা!
আহারে আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা!
আহারে আমার ক্ষতবিক্ষত স্বাধীন বাঙলাদেশ!
শুদ্ধস্বর ডটকমের সাহিত্য সম্পাদক উলুল আমর অন্তর’র ফেসবুক পেজ থেকে।