শামসুন্নাহার হলের সামনে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ ফুচকার দোকান! পাশেই কনক্রিটের তৈরি বেঞ্চ! কয়েকটা! তার একটাতে বসে আছি আমি। পরনে হলুদ পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীটা আমার না। বন্ধুর। কাপড়চোপড় সব ময়লা হয়ে যাওয়ায় বন্ধুর পাঞ্জাবী পরেই এসেছি।
বসে আছি। কনক্রিটের বেঞ্চে। একা একা। অদূরে কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার অপরূপ প্রেমদৃশ্য চলছে। মাঝে মাঝে দেখছি। বসে আছি। কনক্রিটের তৈরি বেঞ্চের ওপর। একা একা। অপেক্ষায়…।
অনেকক্ষণ একা একা বসে থাকা এক উদ্ভট বিরক্তির সৃষ্টি করে! এই সময় তর্জনী-মধ্যমার ফাঁকে অন্তত একটা সিগারেট থাকা দরকার!
পাশে হাঁটতে থাকা সিগারেটওয়ালার কাছ থেকে একটা ‘মালবোরো অ্যাডভান্স’ নিলাম। সিগারেটের মাথায় আগুনের স্পর্শ দিয়ে একটা দীর্ঘ টান লাগালাম। সিগারেটওয়ালাকে বিদায় করতে যাব এমন সময় পাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠস্বর,
-মামা আমারেও একটা দেন। বেনসন।
পাশ ফিরে দেখি অসম্ভব সুন্দরী এক মেয়ে। আমার পাশে বসা। তার দিকে তাকাতেই সে বলে ওঠলো,
-স্পর্শ কেমন আছো জানু…? এতদিন পর আমার সাথে দেখা করবার ইচ্ছা হলো, না?
মেয়েটির কথা শুনে অবাক হলাম! আমার ডাক নাম যে স্পর্শ এটা তো এই কৃত্রিম নগরের কারোর জানবার কথা না! আমি তো কাউকে পূর্বে বলি নি…!
মেয়েটি আমার হাত ধরে ফেললো। শরীরে এক ভয়াবহ রকমের কম্পন অনুভূত হচ্ছে। মেয়েটির ডানহাত থেকে আসা বেনসনের ধুঁয়া আমাকে ক্রমে গ্রাস করে ফেলছে। মনে হচ্ছে এক অজানা ঘোরে আচ্ছন্ন হচ্ছি। বামহাতের সিগারেটের ছ্যাঁকায় ঘোর কিছুটা কেটে গেল। আস্তে করে মেয়েটির হাত আমার হাত থেকে সরিয়ে দিলাম! দেখলাম! গোলাপী ঠোঁটের রৌদ্রজ্জ্বল হাসি কিছুটা ম্লান হয়ে গেল!
সে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। শুষ্কমুখে বলল,
-স্পর্শ? হোয়াট হ্যাপেন?
চঞ্চলা মেয়েটি মুহূর্তেই যেন হাওয়াই মিঠাই এর মতন চুপসে গেল। আমার কেন জানি নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো। কিছুই বলতে পারছি না। মনে হচ্ছে, ক্রমান্বয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলছি! মেয়েটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
-নিজেই তো দেখা করতে চাচ্ছিলা? আর এখন এমন করছো যেন “পূর্ণিমার চাঁদ”(ফেইসবুক আইডি)কে চেনো-ই না!
আমি মেয়েটির চোখের দিকে তাকাতেই আকস্মিকভাবে সে আমাকে জরিয়ে ধরলো। তার বক্ষদেশের স্নিগ্ধ পরশ আমার হৃৎস্পন্দন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল। সে আমার কানের কাছে ঠোঁটজোড়া নিয়ে এসে বললো,
-তুমি ভাবছিলা তোমাকে দেখে আমি চিনতে পারব না, না? তোমার পাঞ্জাবীটা দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। হ্যাঁ…! তোমার “চাঁদের স্পর্শ” আইডি(ফেইসবুক)টার কভার ফটোতে তো এই পাঞ্জাবীটার-ই ছবি দেওয়া!
আমার বুক ছেড়ে কনক্রিটের তৈরি বেঞ্চে বসে পড়ল মেয়েটি। ফুচকাওয়ালাকে দু’প্লেট ফুচকা দিতে বললো। ঠিক কি ঘটছে! কিছু-ই বুঝে ওঠতে পারছি না।
কিছুকাল পরেই মনে হলো, আমিতো অপেক্ষায় আছি! বন্ধুর অপেক্ষায়। আমার পাশে অসম্ভব সুন্দরী চঞ্চলা এক মেয়ে। “পূর্ণিমার চাঁদ”! পায়ের দুপাশে দুটা সিগারেটের মৃতদেহ। কিন্তু, আমিতো অপেক্ষায় আছি…! বন্ধুর অপেক্ষায়! বন্ধু সৌমিকের অপেক্ষায়! সৌমিকের কথা আসতেই মনে পড়ে গেল, সৌমিকের ফেইসবুক আইডির নাম-ই তো, “চাঁদের স্পর্শ “! আর ওর কভার ফটোতে তো এই হলুদ রঙের পাঞ্জাবীর-ই ছবি দেওয়া। যেটা আমি পরে এসেছি। এটা তো সৌমিকের-ই। আমার কাপড়চোপড় ময়লা হওয়ায় পরে এসেছি। এসব ভাবতেই ,লালরঙা সাইকেলটি নিয়ে ও আসলো। সৌমিক। আমার বন্ধু। যার জন্য আমি অপেক্ষায় ছিলাম। মেয়েটির সামনে গিয়ে সৌমিক মোটামুটি এক নিঃশ্বাসে বলল,
-হ্যালো পূর্ণিমা। কতক্ষণ আগে এসছো? আমাকে চিনতে পারছো তো? আই আম ইওর স্পর্শ! “চাঁদের স্পর্শ”! আর এই যে হলুদ পাঞ্জাবী পরা ভদ্র ছেলেটি দেখছো না? ও আমার খুব ভাল বন্ধু। তোমাকে যার কথা বলেছিলাম। খুব ভাল কবিতা লেখে। তোমার জন্মদিনে তোমাকে যে কবিতা দিয়ে উইশ করলাম! সেটা তো ওর-ই লেখা ছিল!
আচমকা মেয়েটি ওঠে দ্রুতবেগে হাঁটতে শুরু করলো। পেছন ফিরে আমার দিকে এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললো। আমার ভেতরে ভয়ঙ্কর এক কালবৈশাখী বয়ে গেল। অনুভব করলাম। সৌমিক কিছু বুঝে ওঠতে পারছে না। সাইকেল নিয়ে মেয়েটির পিছু নিলো সৌমিক! একটু দূরে গিয়ে মেয়েটিকে ধরে ফেললো সে! তারপর কিছুকাল খানিকটা দূর থেকে ঝাপসা দৃষ্টিতে ওদের মৌন কথোপকথনের দৃশ্য দেখলাম! একটু পর মেয়েটি সৌমিকের লাল সাইকেলে উঠে বসলো! লাল সাইকেলটি ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল! নিয়ে গেল দুজনকে! “পূর্ণিমার চাঁদ” আর “চাঁদের স্পর্শ”! পেছনে রয়ে গেল দুটো দগ্ধ হয়ে যাওয়া সিগারেটের মৃতদেহ! দুই বাটি ফুচকা! আর ভয়ঙ্কর এক কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া একটি মনের মৌন আর্তনাদ…!

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.