দুনিয়ায় বহু মাথা মোটা লোক আছেন, যারা বড় বড় প্রতিষ্ঠানে মোটা বেতনের চাকরী করেন।
কোম্পানী তাদের এত টাকা কেন দেয় কে জানে !
অফিসের পঞ্চম তলায় সেইরকম এক মাথামোটা ম্যানেজারের রুমে ঢুকলাম।
একদম সুনসান, নিরব! এসির বিজবিজ শব্দ শোনা যাচ্ছে। শীতল মৃদুমন্দ বাতাসে ম্যানেজার সাহেবের ফাইলের পাতা উল্টানোর খসখস আওয়াজ হচ্ছে। জানালার ওপাশ থেকে পাখিদের মিঠা গলার গান ভেসে আসছে। আমি ম্যানেজার সাহেবকে বললাম,
– আমীন ভাই, আপনার পিছন দিকে কী পাখি ডাকছে, বুলবুলি নাকি ?
– আরে না চড়ুই টড়ুই হইবো।
আমি বললাম,
– না না, চড়ুই পাখির গলার আওয়াজ এত মিঠা হয় না।
তিনি এবার বিরক্ত হয়ে বললেন,
– আরে ভাই, চড়ুই, বুলবুলি একইতো কথা। ওদের চেঁচামেচি আবার তিতা মিঠা হইলো কবে থেইকা ! এগুলার কিচির মিচির বড়ই বিরক্তিকর! সকালের কাঁচা মিঠা ঘুমটা ভেঙে যায়। অফিসে এসেও শান্তি নাই।
– আমীন ভাই, বুলবুলির গলা কিন্তু বেশ মিষ্টি। গ্রামে এদেরকে আমরা কুলঝুটি বলি। এদের নিয়ে একটা ছড়াও আছে –
“কুলঝুটি কুলঝুটি তোর পুঙা রাঙা ক্যা
আল্লাহ তালা বানিয়ে দিছে তুরা কবি ক্যা”
ম্যানেজার সাহেবের পিছনের পর্দা সরিয়ে দেখি, সেখানে দূটো বুলবুলি জানালার ধারে ব’সে গলাগলি করছে। মাথামোটা ম্যানেজার সাহেবকেউ জোর করে দেখালাম। চড়ুই পাখির জায়গায় তিনি বুলবুলি দেখে প্রচণ্ড রেগে গেলেন। হাতে বন্দুক থাকলে বোধহয় তিনি গুলি করতেন। মনে হলো, এই সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী! চড়ুই পাখি তাড়িয়ে দিয়ে, বুলবুলিকে আমিই এখানে ডেকে এনেছি।
তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেল,
– পাঁচ তলার উপরেও এসব যন্ত্রণা কোত্থেকে যে আসে !
এমন সময় ফ্যাক্টরি ফ্লোরের এক লাইন সুপার ভাইজার রুমে ঢুকে ম্যানেজার সাহেবকে বললো,
– স্যার, স্যুইংগার্ল রুখসানা কাজের মধ্যে পা ঝ্যাকাচ্ছে আর গান গাচ্ছে। সবাই বলছে, সে নাকি সাবিনা ইয়াসমিন হবে।
ম্যানেজার সাহেব বললেল,
– সে কী গান গাচ্ছে ?
– স্যার, সে এই গানটা গাচ্ছে-
“পথের ধারে নামহারা ফুল
ফোটে কত রাত্রি দিনে,
যে তারে চিনতে পারে
দাম দিয়ে তারে কেনে”
– ডাক দাও সাবিনারে, পথের ধারের নামহারা ফুল কিনাচ্ছি।
সাথে সাথে তাকে ধরে আনা হলো। ম্যানেজার সাহেব অতি মোলায়েম সুরে তাকে বললেন,
– বেগম রুখসানা ইয়াসমিন, তুমি নাকি কাইম-কাইজ বাদ দিয়া গান গাইয়া বেড়াইতেছ ?
– না স্যার, আমি কাজ করছিলাম আর গুনগুন করে গান করছিলাম।
– ঠিক আছে গান করো, আমি তোমার আজকের হাজিরাটা কাইটা দিলাম। মাসের শেষে বাকী টাকা পেলে পথের ধারের নামহারা ফুল কিনে নিও।
রুখসানারা বেরিয়ে যাবার পর ম্যানেজার সাহেব আমাকে কিছু উপদেশ দিলেন।
– দ্যাখেন হাবিব সাহেব, জীবনটা অনেক কঠিন। জীবন পাখির গানের সুরের মত রোমান্টিক না।
জীবনে উপরে উঠতে হলে, বুলবুল ময়না টিয়া পাখির গান শুনলে চলেনা। আপনাদের ঐ পথের ধারের দুর্বাঘাসের চিকন চিকন পাতার ফাঁকে ফুটে থাকা কতশত নামহারা ফুলকে জুতার তলায় মাড়িয়েই সামনে এগিয়ে চলতে হয়।
ম্যানেজার সাহেবদের কথাই হয়তো ঠিক!
পায়ের নিচের কতশত নামহারা ফুল মাড়িয়ে চলতে চলতে কেহবা এত উপরে উঠে যায় যে, সেখান থেকে গাছে গাছে ফুটে থাকা ফুলকে আর দেখা যায়না, চেনা যায়না। গাছে গাছে ব’সে থাকা পাখির কূজন আর শোনা যায়না !
আহসান হাবীব