বাঙালী জাতির ইতিহাসে স্মরণকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালী হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহন করেননি।বঙ্গবন্ধু হিসাবেও পরিচিত হননি।এটি অর্জনের পেছনে দীর্ঘ সাধনা আর ত্যাগের যে চরম পরাকাষ্টা-সে বিষয়ে আমাদের জানার আগ্রহ কম বললেই চলে।একজন বঙ্গবন্ধুকে তৈরী করতে আরো অনেকের ত্যাগের বিষয়টিও উপেক্ষিত বলে বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞদের বলতে শুনা যায়।তবে একথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে যে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু নাম দূ’টিকে আলাদা করা যাবেনা।পরস্পর সমার্থক।বাংলাদেশের নাম নিলেই যে নামটি চলে আসবে তিনি আর কেউ নন-মুজিবর।এক নামে বঙ্গবন্ধু নামে যিনি বাঙালীর হৃদয়ের মনিকোটায় জায়গা করে নিয়েছেন।
তিন দিক থেকে ভারত আর একদিকে মায়ানমার(বার্মা) ঘেরা আমাদের দেশ বাংলাদেশ।প্রাচীনকালে বাংলা নামে কোন জনপদের নাম ছিলো বলে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না।বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের তথ্য থেকে-
“পুন্ড্রভদ্র,সূমাহা,রাঢ়,গৌড়,ভদ্রমনা,বঙ্গ,চন্দ্রদ্বীপ,সমতট,হরিকেল,বরেন্দ্র,কর্ণসূবর্ণ,লাখনূটি,সূবর্ণবিথী,নব্যকূশিকা নামে নৃপতি শাসিত ছোট ছোট স্বাধীন জনপদ ছিলো প্রায় দূ’হাজার বছর আগে।”গুপ্তযুগের আগে রাজা ধননান্দের অধীনে এসব অঞ্চল শাসিত হতো।এছাড়াও মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত এসব এলাকা শুঙ্গ আর কুশানরা শাসন করতো।গুপ্তযুগের পর রাজা শশাঙ্ক অনেকটা সার্বভৌম রাজা ছিলেন বলে জানা যায়।অত:পর মাৎসান্যায় যুগের কথা ঐতিহাসিকদের লেখায় দেখা যায়।এরপর বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী পাল বংশের রাজত্বের পর হিন্দু ধর্মের ক্ষত্রিয় যোদ্ধার জাত সেনবংশের যুগ।
চতুর্দশ শতকে সুলতান শামশুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বর্তমানের বাংলাদেশ,ভারতের পশ্চিম বঙ্গ,বিহার,উড়িষ্যা,আসাম,মেঘালয় ও ত্রিপুরা ইত্যাদি পৃথক পৃথক অঞ্চলগুলোকে একত্রিত করে নামকরণ করেন ‘বাঙ্গেলা’।প্রথমবারের মতো ঢাকাকে রাজধানী হিসাবে বেছে নেয়া হয়।ষোড়শ শতকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে শ্রী চৈতন্য দেবের জাতপাতমুক্ত সমাজ ও ইসলামের উঁচুনিচু ভেদাভেদহীন ধ্যানধারনাকে কেন্দ্র করে এক নতুন সমাজের জন্ম হলে বাংলাভাষা রাজকীয় মর্যাদা লাভ করে।
১৫২৬ সালে মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ভারত উপমহাদেশে।১৫৭৮ সালে পর্তুগীজ ও ১৬১২ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ব্যবসার নামে বাংলার মাটিতে ঘাঁটি স্থাপন করে।সম্রাট আকবরের আমলে কৃষিকাজের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলা মাস গননার বিষয়টি তাৎপর্য্যপূর্ণ।সুবে বাংলা নামে এই অঞ্চলকে মোগলরা শাসন করেছিলো।উনবিংশ শতাব্দীতে ফকির লালনশাহের আবির্ভাবও গুরুত্বপূর্ণ।১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর পরাজয় এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন শুরু।১৮৫৭ সালে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে সিপাহী বিপ্লব ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতার লক্ষ্যে গুনগত পরিবর্তনের এক উল্লেখযোগ্য দিক।১৮৫৮ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বিলোপ করে সরাসরি বৃটিশরাজ বাংলার ক্ষমতা গ্রহন করে।১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠন করা হয়।১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গের ঘোষনা।১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম।১৯১১ সালে বঙ্গবঙ্গ রদ করা হয়।ক্ষুদিরাম,সূর্যসেন তিতুমীর হাজী শরীয়তউল্লাহর আত্মদান ঐতিহাসিক।এককথায় স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ওয়াহাবী,ফারায়েজী,তেভাগা,সন্ন্যাস বিদ্রোহ,সন্ত্রাসবাদী,অসহযোগ আন্দোলন পরবর্তিতে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কাব্য ও সাহিত্যে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্রোহী কবি নজরুলের আবির্ভাব ঘটে।ভারতীয় উপমহাদেশে একদিকে মহাত্মা গান্ধী,মওলানা আবুল কালাম আজাদ,জওয়াহেরলাল নেহেরু,সরদার প্যাটেল,সরোজিনী নাইডু,মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ,লিয়াকত আলী খান,সীমান্তগান্ধী খ্যাত আব্দুল গাফ্ফার খান,অন্যদিকে দেশবন্ধু চিত্তরন্জন দাস,শ্যামাপ্রসাদ মূখার্জী,শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,নেতাজী সুভাষ বোস,মওলানা ভাসানীর মতো কালজয়ী নেতাদের আবির্ভাব ও উত্থান বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে নবযুগের সূচনা লক্ষনীয়।স্বাধীনতার লক্ষ্যে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত নন ভায়োলেন্ট অসহযোগ আন্দোলন অন্যদিকে নেতাজী সূভাষ বোস পরিচালিত ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’য়ের সশস্ত্র আন্দোলন খূবই তাৎপর্য্যপূর্ণ।এমন একটি মোক্ষম সময়ে অখ্যাত টুঙ্গীপাড়ার সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রনেতা হিসাবে কলকাতায় অবস্থান বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দীর অন্যতম রাজনৈতিক শিষ্য হিসাবে মহাত্মা গান্ধীকে কাছে থেকে দেখার সূযোগ পান এবং নেতাজী সূভাষ বোসের সশস্ত্র আন্দোলনের বিষয়ে কাছে থেকে দেখতে পান।যা পরবর্তিতে অসহযোগ ও সশস্ত্র আন্দোলনের সমন্বয় সাধনে বিভিন্ন গ্রুপের সাথে প্রকাশ্যে বা গোপনে কাজ করার অনুপ্রেরনা যুগিয়েছিলো।বিশেষ করে শেখ মুজিবকে জানতে হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সহ শেরে বাংলা ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীকে জানতেই হবে।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তান ও ১৫’ই আগষ্ট ভারত বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে।স্বাধীনতা অর্জন করে।শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান ও মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন।আওয়ামী মুসলিম লীগে মওলানা ভাসানী সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন।মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে কেবলমাত্র ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নামকরন রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট।কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগে ভাঙন।মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক।পরবর্তিতে সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও সাধারন সম্পাদক শামশুল হক।তৎপরবর্তিতে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারন সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কৌশলে ধারাবাহিক কার্যক্রমের দিকে দলকে পরিচালনার প্রচেষ্টা।বিশেষ করে ছাত্রলীগের সাথে বিশেষ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের শক্তির সাথে ভারসাম্য বিধান করে আওয়ামী লীগকে পরিচালনার বিষয়টি বিজ্ঞ মহলে আলোচিত সমালোচিত।কারন ছাত্রলীগ স্বাধীনতার পূর্বে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছিলোনা।ছাত্রলীগের নেতারা কেবলমাত্র বেগম মুজিব ও শেখ মুজিবের সাথে সংযোগ রক্ষা করতেন।ছাত্রলীগের সাথে চট্টগ্রামের এম এ আজিজের গভীর সম্পর্কের জনশ্রুতি আছে।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে জিন্নাহর বিরোধিতা,বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলনকে ঘিরে বহি:স্কার,ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিবের কারাবরণ প্রনিধানযোগ্য।তারপরতো কারাজীবনের সে এক দীর্ঘ কাহিনী।যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে দেশব্যাপী বিচরন ও মন্ত্রিত্ব গ্রহন। দলের প্রয়োজনে মন্ত্রিত্ব বর্জন উল্লেখ করার মতো।সেনানায়ক ইস্কান্দর মির্জা ও তারপর আইয়ূব খানের ক্ষমতা গ্রহনের পরপর শেখ মুজিবকে ঘন ঘন কারাগারে গমন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে বসে।তখন আওয়ামী লীগ অফিসে বসার লোকও পাওয়া যেতোনা।এমনি এক দূ:সহ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারাদেশের ছাত্রলীগের মধ্য দিয়েই শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের দূ:সময়ের দিনগুলো অতিবাহিত হতে থাকে।১৯৬২’সালে শিক্ষা আন্দোলন শুরু হলে তখনও ছাত্র ইউনিয়ন সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় সংগঠন হিসাবে পরিচিত।এমনি এক সময়ে ছাত্রলীগের কনভেনশনে সিরাজুল আলম খান সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ছাত্রলীগকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিলে ধারাবাহিকভাবে জনপ্রিয়তায় ছাত্র ইউনিয়নের চাইতেও এগিয়ে যেতে থাকে।১৯৬২’সালেই সিরাজুল আলম খান,আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরিফ আহমেদ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াস গঠন করার কথা এখন সর্বজনবিদিত।স্বাধীনতা অব্যবহিত পূর্বে সারাদেশে সাতহাজার নিউক্লিয়াসের সদস্যের কথা বিভিন্ন লেখায় দেখা যায়।১৯৬৫ সালে শেখ ফজলুল হক মনি ছাত্র রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহন করলে ছাত্রলীগে সিরাজুল আলম খানের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্টিত হয়।ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে অবস্থান করলে প্রায়সময় সিরাজুল আলম খানকে আওয়ামী লীগ অফিসে বসে থাকার বিষয়টি অনেককে বলতে দেখা যায়।১৯৬৬ সালে জেল থেকে মুক্তির পর গোলটেবিল বৈঠককে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা ঘোষনা করেন।পাকিস্তানের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।ঢাকায় ফিরে এলে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের অনেকের বিরোধিতা মূখে সিরাজুল আলম খান ও ছাত্রলীগ শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে শক্ত অবস্থান গ্রহন করে।কনভেনশন মুসলীম লীগের ফজলুল কাদের চৌধূরী আর আওয়ামী লীগের একাংশের শক্ত বিরোধীতা স্বত্তেও চট্টগ্রামের এম এ আজিজের ও ছাত্রলীগের সদস্যদের শক্ত অবস্থানকে কেন্দ্র করে স্বয়ং মুজিবর কর্তৃক চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে ৬ দফা ঘোষিত হলে লক্ষ জনতা করতালি ও মুহুর্মুহু শ্লোগানের মাধ্যমে তা অনুমোদন করে।আইয়ূবশাহীর ষডযন্ত্র ভয়াবহ আকার ধারন করে।ইতিমধ্যেই ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে।ছাত্রইউনিয়ন চীন ও রাশিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তাদের জনপ্রিয়তায় বিরাট ধ্বস নামে।৬ দফার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ১১ দফা ঘোষিত হলে ছাত্র ইউনিয়ন ১১ দফাকে সমর্থন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে অংশগ্রহন করতে বাধ্য হওয়া ব্যতিত তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাদের আর কোন পথ খোলা ছিলোনা।ততদিনে ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ ও সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন আ স ম আবদুর রব।ছাত্রলীগ কেবলমাত্র ছাত্রছাত্রী ছাড়াও শ্রমিক ও সাধারণ জনমানসে স্থায়ী আসন তৈরী করে নেয়।বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষডযন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হলে ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আন্দোলন দাবানলের মতো সারাদেশ ছডিয়ে পড়ে।তোফায়েল আহমদ তখন ডাকসূ ভিপি।এই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিভিন্ন বক্তারা সিংহশার্দুল বা বঙ্গশার্দুল বলে অভিহিত করতো।এমতাবস্থায় ১৯৬৮ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের সম্পাদক রেজাউল হক চৌধূরী মুশতাক প্রতিধ্বনি নামে চারপাতার প্রচারপত্রে সারথী ছদ্মনামে বঙ্গবন্ধু শব্দটি উল্লেখ করেন।তা সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনির ভীষন মনপুত হয়।তবে আইয়ূবশাহীর বর্বরতা থেকে ঢাকা কলেজের নেতৃত্ব যাতে মুক্ত থাকতে পারে তাই সাময়িকভাবে এটি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।অবশ্য উপযুক্ত সময়ে তা কাজে লাগানোর কথা জানিয়ে দেয়া হয়।আগরতলা ষডযন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর ততদিনে সারাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান একক নেতা হিসাবে জনমনে অধিষ্টিত হয়।জেল থেকে মুক্তির পর ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা সভায় ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপের বিরোধিতা স্বত্ত্বেও সিরাজুল আলম খান ও অন্যান্যদের সিদ্বান্তক্রমে ডাকসূ ভিপি ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা হিসাবে তোফায়েল আহমদ “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”বলে ঘোষনা করলে লক্ষ জনতা মুহুর্মুহু করতালি ও শ্লোগান সহকারে তা অনুমোদন করে।এভাবেই বাঙালী জাতি তাঁর সর্বশ্রেষ্ট সন্তানকেই বঙ্গবন্ধু অভিধায় অভিষিক্ত করেছিলো।যা চলছে ও চলবে।
বঙ্গবন্ধু অভিধায় অভিষিক্ত হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর অনুরূধে সিরাজুল আলম খান,শেখ ফজলুল হক মনি,আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে নিউক্লিয়াস পরবর্তি বি এল এফ পূণর্গঠিত হয়।কাজী আরেফকে বি এল এফ গোয়েন্দা প্রধান হিসাবে গোপনে নিয়োগের বিষয় এখন আলোচিত হতে দেখা যায়।আইয়ূবশাহীর পতন হলে ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসক হিসাবে নির্বাচন দিলে ততদিনে ছাত্রলীগের চার নেতাকে চার খলিফা হিসাবে সারাদেশের জনগনকে বলতে দেখা গেছে।ক্রমশ:’চার খলিফা’ শব্দটিও বাঙালী জনমানসে স্থায়ী আসন লাভ করে।ছাত্রলীগের এই চার খলিফা খ্যাত ডাকসূ ভি পি আ স ম আবদুর রব,ডাকসূ সাধারন সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন,ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী,ছাত্রলীগ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ উল্কার বেগে সারাদেশ চষে বেড়ায়।তখনকার দিনে ছাত্রদের কথা সাধারণ জনগন দৈববানীর মতো মেনে নিতো।বঙ্গবন্ধুর বাঙালী জাতির একক নেতা ও আওয়ামী লীগকে একক জনপ্রিয় সংগঠনে পরিনত করার পেছনে ১৯৭১’ পূর্ববর্তি জেনারেশনকে ছাত্রলীগের চার খলিফার কর্মকান্ডের কথা বলতে দেখা যায়।নির্বাচনে অবশেষে পাকিস্তানের সকল গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট মিথ্যা প্রমানিত করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে।
ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তালবাহানা চলতে থাকে।একপর্যায়ে ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট স্থগিত ঘোষনা করলে সারাদেশ আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠে।ছাত্রজনতার প্রবল চাপে বি এল এফ নেতাদের পরামর্শক্রমে ১৯৭১’সালের ১’লা মার্চ চার খলিফার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ঘোষিত হয়।২’রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ডাকসূ ভিপি ও সংগ্রাম পরিষদের নেতা আ স ম আবদুর রব ছাত্র জনতার মুহুর্মুহু করতালি ও শ্লোগানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।৩’রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনির্ধারিতভাবে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক শাজাহান সিরাজ।সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার স্থপতি ঘোষনা,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তোলিত পতাকাকে স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা,কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালবাসি”গানটি জাতীয় সংগীত হিসাবে ঘোষনা সহ আরও বিস্তারিত কর্মপন্থা ঘোষিত হয়।জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্ধারনের ক্ষেত্রে নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তের বিষয়টি বিভিন্ন লেখাতে দেখা যায়।৭’ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তথা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পরবর্তি জনসভার ঘোষনা দেয়া হয়।৩’রা মার্চের পরপরই বি এল এফের চার নেতা,চার খলিফা ও বংগমাতা বেগম মুজিবের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গঠনের কথা জানা যায়। সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালী জাতির স্মরণকালের ঐতিহাসিক ভাষন দান কালে তিনি বলেন-“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”এর পর আর বাকী থাকে কি?২৩’শে মার্চ পল্টন ময়দানে পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়।সারাদেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়।পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়।এলো ২৫’শে মার্চ।মধ্যরাতে বর্বর পাকবাহিনী স্মরনকালের বৃহত্তম গনহত্যা শুরু করে।বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দ্রুততম সময়ের ব্যবধানে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধে রূপান্তরের প্রক্রিয়া অবাক বিস্ময়ে সারা দুনিয়া তাকিয়ে রইলো।জনযুদ্ধ চলাকালীন বর্বর পাকিস্তানের সামরিক শাসক কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর বিচার ও ফাঁসীর বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচিত।নয়মাসের ব্যবধানে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী সমন্বয়ে দেশ স্বাধীন হলো।১৯৭২’সালের ১০’ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন বিজয়ীর বেশে।এসেই স্বাধীন দেশের শাসনভার গ্রহন করলেন।চক্রান্তকারীদের কৌশলে যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে দূরে সরিয়ে খন্দকার মোশতাককে সবসময় ৩২’নম্বর ধানমন্ডীর বাসায় বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো।জনশ্রুতি আছে যে,৩২’নম্বরের বাড়ীতে খোন্দকার মোশতাকের প্রবেশের পর থেকেই মহিয়সী বেগম মুজিবকে কেউ হাসতে দেখেনি।অন্যদিকে সিরাজুল আলম খান কর্তৃক বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন ও অন্যান্য দাবীকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার গঠিত হলে সদ্য যুদ্ধফেরত অধিকাংশ তরুন তুর্কীরা বিদ্রোহী মনোভাব পোষন করতে থাকে।তাছাড়াও স্বাধীনতাপূর্ব বিরোধীতার জের ধরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ যথাক্রমে পল্টন ও রেসকোর্স ময়দানে অবশ্য বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে ছাত্রলীগের কনভেনশনের আয়োজন করে।তবে পরবর্তিতে বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র রেসকোর্সের সভায় যোগ দিলে ছাত্রলীগের পল্টনের অংশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।পরে সিরাজুল আলম খানের নির্দেশনায় স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তথা জাসদ আত্মপ্রকাশ করে।১৯৭৪’সালে দেশীয় ও বিদেশী চক্রান্তে দূর্ভিক্ষ দেখা দিলে কিংবা নানা অরাজক অবস্থা ঘরের ভেতরে ও বাইরে দেখা গেলে বিশেষ বিবেচনায় চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ন্যাপ মোজাফফর ও কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে বাকশালের আত্মপ্রকাশ ঘটে।১৯৭৫’সাল।ততদিনে নদীর জল অনেক গড়ালেও বঙ্গবন্ধু অনেক গোয়েন্দা রিপোর্ট কে পাত্তা দেননি এই ভেবে যে-“কোন বাঙালী অন্তত:তাকে হত্যার চিন্তাও করতে পারেনা।”অবশেষে এলো সেই শোকাবহ দিন।পনেরোই আগষ্ট।বাঙালী জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু সহ স্বপরিবারে ইতিহাসের বর্বরতম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের দিনটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শোকের দিন হিসাবে বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশ স্মরণ করবেই।বিশ্বাসঘাতক খূনী মোশতাক চক্রকে জাতি কখনো ক্ষমা করবেনা।বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপর দিয়ে আওয়ামী লীগের মোশতাক গং ক্ষমতার মসনদ দখলের বিষয়টি ছাড়াও জিয়া চক্রের সংশ্লিষ্টতা বিশিষ্ট সাংবাদিক অ্যান্তনী ম্যাসকারেনহাস কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর খূনী ফারুক রহমানের সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়কে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতি কখনো ভূলবেনা।অবশ্য বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু তৎপরবর্বর্তি প্রতিবাদ জানানো ও মোশতাক-জিয়া চক্রের সাথে ক্ষমতার সহযোগীদের নিয়ে গবেষনা এখনো চলছে।তাছাড়াও বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা: মাহফুজুর রহমানে লেখায় প্রশ্ন- “বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথমে প্রতিবাদ জানানো উচিত ছিলতো আওয়ামী লীগের। এবং তাদের ক্ষমতার পার্টনার মোজাফফর ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির।আর জানানো উচিত ছিলো বঙ্গবন্ধু যাদের বাকশালে নিয়েছিলেন সেই মে.জে.শফিউল্লাহ,মে.জে.জিয়ার।সবচাইতে অবাক করা ব্যাপার হলো তখন দেশের উপ রাষ্ট্রপতি ছিলেন সম্ভবত:সৈয়দ নজরুল ইসলাম।প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হলে তারই প্রেসিডন্ট হওয়ার কথা এবং একই সাথে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ার কথা।প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনচুর আলী।এই দুইজন ব্যক্তিত্ব কেন দ্রুততার সাথে এগিয়ে এলেননা—-।”অনেককে বলতে শুনা যায়-আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন আওয়ামী লীগের বাইরের শত্রুর দরকার হয়না।তোষামোদকারী,মোসাহেব আর অতি ভক্তিসম্পন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্টের লোকজন চতুর্দিকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যে-ত্যাগী কর্মীরা লজ্জায় লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়।শোকাবহ আগষ্টকে শক্তিতে পরিনত করতে হলে বঙ্গবন্ধুর মতো নির্লোভ,নির্মোহ ও উদার হতে হবে।অর্থ ও ক্ষমতার মোহ কিংবা দাম্ভিকতা অথবা অশিষ্ট আচরনের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।বর্তমানের ও আগামী প্রজন্মের সন্তানেরা যাতে আমাদের দায়ী করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।ইতিহাসের এই কালো অধ্যায় থেকে শিক্ষা গ্রহনের শেষ নেই।নিরন্তর গবেষনার বিকল্প নেই।মূখে বললেও ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহনের নজির আজকাল নেই বললে চলে।আমাদের স্মরণ রাখতে হবে-সত্য প্রকাশিত ও মিথ্যা একদিন ভূলূন্টিত হবেই।মৃত্যুন্জয়ী বঙ্গবন্ধুর দেশ বাংলাদেশ।এভারেষ্টশৃঙ্গকে সমুন্নত রাখতে হলে হিমালয়ের চতুর্পার্শ্বের পর্বতরাজিকে সুশোভিত করে তুলতে হবে।শহর,বন্দর ও গ্রামের নদী ও পাহাডগুলোকেও সাজিয়ে তুলতে হবেই।বাংলাদেশের আগামী দিনগুলো সাম্য,সামাজিক ন্যায়বিচার,দূর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মানে সর্বোপরি গনতান্ত্রিক আচরনের সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে এগুলেই কেবল তখন বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি নিশ্চিত হবে।
তথ্যসূত্র:
অসমাপ্ত আত্মজীবনী:শেখ মুজিবুর রহমান
একুশ শতকে বাংলাদেশ-সিরাজুল আলম খান।
Education in Ancient India-Hartmut Sgharfe
বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব-নীহাররঞ্জন রায়।
মোস্তফা জব্বার,জাগো নিউজ24.কম
মহিউদ্দিন আহমদের জাসদের উত্থান পতন
বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ফেসবুক ষ্ট্যাটাস।
লেখকঃ সিকদার গিয়াসউদ্দিন
লাস ভেগাস,নেভাদা,যুক্তরাষ্ট্র।