“আমি অপার হয়ে বসে আছি
ওহে দয়াময়,
পারে লয়ে যাও আমায় ”
গান শুনছি। যদিও মুসলমান হিসেবে আমাদের জন্য গান-বাজনা হারাম! আমাদের ধর্মে কতকিছুই তো হারাম। ঘুষ খাওয়া হারাম। ধুমপান, মদপান হারাম।
অথচ মসজিদে নামাজ পড়ে বের হয়েই অনেককে দেখি আরাম করে বিড়ি-সিগারেট ধরান।
গত জুম্মায় ইমাম সাহেব বললেন, মদ খাওয়া হারাম কিন্তু রোগের চিকিৎসার উছিলায় ডাক্তার যদি রোজ চার চামচ মদ খেতে বলেন, তখন খাওয়া যাবে।
শিক্ষামন্ত্রী বললেন, সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়া যাবে।
সবকিছুরই বোধহয় একটা লিমিট আছে।
গান-বাজনাও হারাম, হয়তো তারও একটা লিমিট আছে।
যাই হোক, আমি সেইসব হারাম-হালালের তর্কের দিকে যাবোনা। আমি এখন গান শুনছি বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্যা শিল্পীর কন্ঠে। লালনগীতি।
আমি অপার হয়ে বসে আছি
ওহে দয়াময়,
পারে লয়ে যাও আমায়।
শিল্পী ‘পারে লয়ে যাও আমায়’ লাইনটি গাইছেন
‘পাড়ে লয়ে যাও আমায়’।
‘পারে’ ও ‘পাড়ে’র মধ্যে অর্থের কী পার্থক্য রয়েছে তা’ হয়তো তিনি জানেন না। তিনি যে কোন সুরে লালনগীতি গাইছেন আল্লাহ মালুম! শিল্পীর বাড়ী কুষ্টিয়ায় নয় বলে তাঁকে ক্ষমা করে দিলাম 😀
কিন্তু কুষ্টিয়া অঞ্চলের একজন বিখ্যাত শিল্পী একসময়ের ‘ক্লোজ আপ তারকা’ তিনি
‘গুরুগো…… এসব দেখি কানার হাট বাজার’ গানের এই অন্তরাটি গাচ্ছেন-
পণ্ডিত কানা অহংকারে
মাতবর কানা চোগলখোরে।
আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে
জানেনা সীমানা কার।।
‘আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে’ ঠিক হচ্ছে কিনা গুগোলে ঢুকে দেখতে গিয়ে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল।
সেখানে গিয়ে দেখি অলরেডী তারা খুঁটি ‘গেড়ে’ বসে আছেন। তার নিচে লেখা রয়েছে
‘চেনেনা সীমানা কার’ 😀
আসলে হবে ‘জানেনা সীমানা কার’।
কোনটা যে সঠিক হবে, একমাত্র সাঁইজীই বলতে পারবেন। তবে আমার মনে হয়, কানা সাধু, পণ্ডিত ও মাতবররা কার কোন সীমানা না চিনে, না জেনেই তারা আন্দাজে খুঁটি গাড়ে।
হয়তো ওটা ‘গেড়ে’ হবেনা, ‘গাড়ে’ হবে।
লালনের তীর্থভূমির শিল্পীকে আমি ক্ষমা করতে পারলাম না।
লালনগীতি, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক, ছায়াছবি, পল্লীগীতি ইত্যাদি গানের সুর ও ভাবের দিক থেকে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যারা জীবনে দুইচারটা গান শুনেছেন, তারা গানের কথা না বুঝলেও সুর শুনেই বলে দিতে পারেন কোনটা নজরুলগীতি, কোনটা রবীন্দ্রসঙ্গীত লালনগীতি। যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে পল্লীগীতি বলেন তাদের জন্য এই আলোচনা নয় 😀
আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণির যেসকল শিল্পীরা আছেন তাঁরাও লালনগীতি গাইতে গেলে লালনের সেই ভাবের সুর হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা ফিউশন করতে গিয়ে কনফিউশনে পড়ে যান। লালনগীতি গাইতে হলে, দুইচার বছর কুষ্টিয়ার গ্রামে গঞ্জে থাকতে হবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হলে রবীন্দ্রভারতীতে শিখতে হবে।
প্রথমদিকে লালনগীতি একতারা, দোতরা, ডুগী-তবলা, খোল, হারমোনিয়াম, খুনজূড়ী টাইপের বাদ্যযন্ত্রের সাথে বাউল ফকিররাই গাইতেন। তাঁরাই লালনের আসল ভাবে ও সুরে গাইতেন।
তারপর মিডিয়া জগতের বরেণ্য শিল্পীরা যখন আধুনিক ইলেক্ট্রিক্যাল ইনষ্ট্রুমেন্টের সাথে ফিউশন করে গাইতে গেলেন, তখনই কথা ও সুরের মধ্যে পরিবর্তন হতে লাগলো।
অনেকে হয়তো বলবেন, লালনগীতি তো আর মহাভারত নয় যে তার কোন পরিবর্তন করা যাবেনা!
কুষ্টিয়ার বাউল শিল্পী শফি মন্ডলও তো ফিউশন করে লালনগীতি গাচ্ছেন। তাঁর গানেতো কোন ভাব, সুর, ছন্দ ছুটে যায়নি!
যারা বাউল গান শোনেন, তারা শফি মন্ডলের ‘গুরুগো……. এসব দেখি কানার হাট বাজার’ গানটা শুনে দেখবেন।
গুরু বলছেন,
ভাবে প্রেমে মজে থাকো মন
পাগল মনোরে মন আমার।
ভাব ধরে হও ভাবের ভাবি
ভাবেই থাকো অনুক্ষণ
ভাবে প্রেমে মজে থাকো মন।।
সংগীতের সুর ও ভাবে মজে থাকলে আমি দেখেছি,
কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা এই জটিল পৃথিবীর নানা জটিলতা থেকে মুক্ত থাকে। মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আমার বানানের মধ্যেও একশোটা ভুল থাকে। তাতে কিছু যায় আসেনা।
কারণ, আমি কোন বিখ্যাত লোক না 😀
আহসান হাবীব
২৬ জানুয়ারি, ২০১৮