বাংলাদেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মাদক সমস্যা থেকে মুক্তিতে মাদকের সঙ্গে যুক্তদের ধরে ধরে গুলি করাই একমাত্র সমাধান হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন ‘মাদকের সঙ্গে যুক্তদের “শুট অ্যাট সাইট” করতে হবে।’ (প্রথম আলো, ‘মাদকের সঙ্গে যুক্তদের গুলি করাই সমাধান’, ২ জানুয়ারি ২০১৭)। তাঁর এই বক্তব্য যে আইনের শাসনের পরিপন্থী তা বুঝতে আইন বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ ও ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সুস্পষ্ট কারণ ছাড়া কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না যাতে তাঁর জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পদের ক্ষতি হয়; ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারের অধিকার রয়েছে। মাদক ব্যবহারের ভয়াবহতা বৃদ্ধি স্বত্বেও এবং তা জাতির জন্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হলেও এই সব বিধান ‘মাদকের সঙ্গে যুক্ত’ হওয়ার কারণে অবসিত হয় না। একজন মন্ত্রী, বিশেষ করে যিনি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত, নিশ্চয় তা জানেন। তাঁর এই মন্তব্য যে কোনো কাউকেই উদ্বিগ্ন করবে।

মাদকের বিরুদ্ধে কথিত লড়াইয়ের ইতিহাস যারা জানেন তাঁরা নিশ্চয় বুঝতে পারবেন যে, এই ধরনের বক্তব্য কিসের ইঙ্গিত দেয় এবং তাঁর পরিণতি কী হতে পারে। ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তে কমপক্ষে ১২ হাজার নাগরিককে হত্যা করেছেন ‘মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের’ নামে। এর মধ্যে অন্ততপক্ষে ৬০ জন শিশুও আছে। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে গত বছরের অক্টোবরে খানিকটা পিছিয়ে আসলেও ডিসেম্বরে এই কথিত অভিযান আবার শুরু হয়েছে। ‘ওয়ার অন ড্রাগস’-এর আরেক উদাহরণ হচ্ছে মেক্সিকো। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবার পর ফিলিপে কলডেরোন এই ‘যুদ্ধের’ সুচনা করেন। তাঁর ক্ষমতার ছয় বছরে মাদক ব্যবসা কমেনি; মোট যে এক লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশই মারা গেছে সরকারী বাহিনীর হাতে, ২৮ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন, ৮ হাজার অত্যাচারের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে। ‘মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের’ এই ধারা অব্যাহত রেখেছেন তাঁর উত্তরসূরি এনরিকে পেনা নেটো। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ মেক্সিকোর কংগ্রেস এক আইন পাশ করেছে যাতে করে সেনাবাহিনীর হাতে আরো ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমলে শুরু হওয়া এই নীতি দেশের কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে এক ভয়াবহ অবস্থার তৈরি করেছে। বৈষম্যমূলক আইনের পরিণতিতে মাদকের ব্যবসা কমেনি, কেবল আটক ব্যক্তি বেড়েছে।

মাদকের ভয়াবহতা মোকাবেলা করার উপায় নিয়ে সংশ্লিষ্টরা অনেক ধরনের উপায়ের কথা বলেন, তার মধ্যে শিক্ষা, প্রচার, সচেতনতা বৃদ্ধি, চিকিৎসা রয়েছে। কিন্ত “শুট অ্যাট সাইট”-এর যে পরামর্শ একজন মন্ত্রী দিচ্ছেন তা আইনের দৃষ্টিতে বা সমস্যা সমাধানের কথিত কার্যকরী পথ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা পাঠ্যক্রমে মন্ত্রীর এই পরামর্শ যুক্ত হবে না। এর বদলে মাদক ব্যবসায়ে যুক্ত যারা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভ করেন তাঁদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহনের বিষয়ে মন্ত্রীর কোনো পরামর্শ থাকলেই সেটা বরঞ্চ অর্থবহ হতো। “শুট অ্যাট সাইট”-এর হুমকি শক্তি প্রদর্শনের ধারারই প্রতিভূ, তা সমাধানের পথ দেখায় না।

লেখাটি প্রফেসর আলী রিয়াজের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া তার অনুমতি ক্রমে শুদ্ধস্বরে প্রকাশিত হোল । ডক্টর রিয়াজ মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের ইলিনয়স ইউনিভারসিটির রাজনীতি এবং সরকার বিভাগের অধ্যাপক ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading