মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই এসেছি কলকাতায়।এখানে আসা মাত্রই কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিলো,ঢাকার পতন হতে আর দেরী নেই।একদিকে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের মরন পন আক্রমন পাক হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে,অন্যদিকে মিত্রবাহিনী দৃঢ পদবিক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে,টার্গেট ঢাকা।এর মধ্যে ডিসেম্বরের ১১ তারিখে পশ্চিম রণাঙ্গনে পাক বাহিনীর সবচাইতে সুরক্ষিত ঘাঁটি যশোর ঘুরে এসেছেন মুক্তিযুদ্ধকালের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। কী আশ্চর্য ৭ তারিখেই ভারতীয় নবম ডিভিশন এক রক্তাক্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে যশোরে গিয়ে দেখে,ভারী অস্ত্রশস্ত্র,মিলিটারি ভেহিক্যালস এবং বাংকার ত্যাগ করে পালিয়ে গেছে হানাদার পাক সেনাবাহিনী।।এই খবর পাক হানাদার বাহিনীর মনোবলকে এক্কেবারে শূন্যের কোঠায় নিয়ে যায়।বিনাযুদ্ধে যশোর রণাঙ্গন পতনের ঘটনা এই বার্তাই বহন করছিলো যে,পাকিদের দিন শেষ;ঢাকা পতনের আর বেশীদিন বাকী নেই।
ষোলই ডিসেম্বর। কলকাতার আকাশ জুড়ে সন্ধ্যার অন্ধকার তখনো নেমে আসেনি।এর মধ্যেই খবর এসে গেলো,ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছে হানাদার বাহিনী।বাংলাদেশ আজ থেকে,এখন থেকে স্বাধীন।
কোলাহলময়ী কলকাতা নগরী।ঢাকা পতনের খবরে ভোজবাজির মতো বদলে গেলো দৃশ্যপট পুরো মহানগরী যেনো হয়ে উঠলো আতশবাজির শহর।মানুষের আনন্দ উল্লাস,হর্ষধ্বনিতে এক স্বর্গীয় উৎসবের রূপ ধারন করেছে পশ্চিম বাংলার রাজধানী।
দেশ স্বাধীন, স্মৃতির শহর ঢাকা এখন হানাদারমুক্ত।যে প্রতিবাদ,প্রতিরোধের শহর ঢাকাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার ঘৃন্য চেষ্টায় মেতেছিলো পাক শাসকগোষ্ঠী। আজ তাদেরই সৈন্যবাহিনী মাথা নত করে আত্মসমর্পণ করেছে মিত্রবাহিনীর হাতে।হঠাৎ এক অজানা আনন্দে নেচে উঠলো মন।আনন্দের মধ্যেই সম্বিত ফিরে পেলাম,উপলব্ধি করলাম নিজের অজান্তেই ভেসে যাচ্ছি আনন্দাশ্রুজলে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মনের আয়নায় ভেসে উঠলো শহীদ স্বপন চৌধুরীর ভুবন ভোলানো হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি।মাত্র দুতিন সপ্তাহ পূর্বেই পেয়েছিলেম সেই মর্মন্তুদ সংবাদ–ছাত্রযুবনেতা স্বপন চৌধুরী বন্দী হয়েছেন চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে পাক সেনাদের হাতে।এবং বন্দী হওয়ার পর অমানুষিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাকে।পরে শুনেছি,নির্যাতনের সময়ে তাঁর চিৎকারে আশপাশের মানুষ কেঁদেছে,কেঁদেছে প্রকৃতিও।
স্বপন চোধুরী শুধু একজন সাধারন মানুষের নামমাত্র নয়।এই মানুষটিই প্রস্তাব এনেছিলেন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের।দু:খ,তাঁর স্বাদের,স্বপ্নের বাংলাদেশের স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারলেন না!একজন মানুষ,যিনি ছিলেন শিশুর মতো সরল,কিন্তু দেশের ডাকে,পিতৃভূমির ডাকে যিনি দিয়ে গেলেন প্রাণ।একা নয়,সংগে আরো জীবন দিয়েছে,রক্ত দিয়েছে আরো তিরিশ লক্ষ মানুষ।
রক্তঝরা একাত্তরে বিশেষত: ৭ ই মার্চ জাতির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষন থেকে ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্যবর্তী সময়টুকু অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
কারন এই সময়টুকু হচ্ছে বাঙালীর জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকাল।নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করা যায় এই বলে যে,এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বাঙালি জাতির পরিচয়পত্র;এই রাষ্ট্র তার চিরস্থায়ী অবিনাশী ঠিকানা।
বিজয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বিভাজন-বিভক্তি,একটি সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ গ্রহনে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ব্যর্থতা সমুদয় বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল।মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনৈক্য,বিভেদ ও ভুল বুঝাবুঝি, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অংগনে সার্বক্ষণিক ষড়যন্ত্র সব মিলিয়ে একটা অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।
তারই পরিনতি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্মম হত্যাকান্ড,পরবর্তী সময়ের দীর্ঘ সামরিক ফ্যাসিবাদী শাসন,স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি,মানবতাবিরোধী জঙ্গীবাদের উত্তান প্রচেষ্টা ইত্যাদি মিলে স্বাধীনতা পরবর্তী চার দশকে বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের মহৎ আদর্শ ও চেতনা থেকে ক্রমাগত বিচ্যুত হয়ে চলেছে।এখনও তার বিরাম নেই।
এই উলটোপথে যাত্রা,এই বিচ্যুতি ও মিথ্যাচারকে মেনে নেওয়া যায়না।কেননা এটা হয়ে পড়বে আত্মহত্যার নামান্তর।বাঙালির মহান গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও আদর্শবিরোধী মহলের চক্রান্ত থেমে নেই,কখনো থেমে ছিলোনা।একাত্তরে পরাজিত শক্তির সুপরিকল্পিত কৃষ্ণ গহ্বর থেকে বাঙালি জাতির হাজার বছরের এই মহাকাব্যকে ইতিহাসের উজ্জ্বল অঙ্গনে পূন:প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরী।কারন একটি মহান জাতির একটি মহত্তম সাফল্যের অমূল্যএই মহাকাব্য মানব ইতিহাসের অনন্য সাধারন ঘটনা।
লেখক- রায়হান ফেরদাউস মধু ,সাবেক ছাত্রনেতা
কত কিছু যেন বাদ রয়ে গেল। ডিটেইল বলুন মধু ভাই। আর সময় থাকবে না বলার। এখন তো গল্প বানানো হচ্ছে বেশি।
ধন্যবাদ ! লেখাটা সহজ, সুন্দর , সাবলীল । ভালো লেগেছে । লেখালিখি চলুক !
চমৎকার লিখা
খুব ভালো লাগলো লেখাটি । আশা করছি আমরা আরও অজানা কাহিনী জানতে পারবো আপনার কাচ থেকে ।