সাহিত্যের একটি বড় উপাদান সে সঙ্গ দেয় , সম্ভবত এইজন্য ‘ সহিত ‘ শব্দের সাথে সাহিত্যের সাযুজ্য বা সংযোগ। সময় এখানে চিরকাল বর্তমান। বাংলা সাহিত্যে বাউল শব্দের সর্বপ্রথম প্রয়োগ দেখা যায় শাহ মুহম্মদ সগীর ( ত্রয়োদশ -চতুর্দশ শতক) রচিত ‘ ইউসুফ জোলেখা ‘ কাব্যগ্রন্থে। এই গ্রন্থে ইউসুফের প্রতি জোলেখার প্রেম বা আর্তি বোঝাবার জন্য বাউর , বাউল এবং আউল শব্দের প্রয়োগ করা হয়। এরপর উজির বাহরাম উদ্দিন এর ‘ লাইলী – মজনু ‘ কাব্যগ্রন্থে মজনুকে বাউল, বাউর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে ‘ বাউল’ শব্দের উল্লেখ আছে। স্রষ্টার প্রেমে পাগল অর্থে বাভূল বা ব্যাকুল থেকে বাউল শব্দ নিস্পন্ন হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। অনেকের মতে আরবী আউল থেকে বাউলের জন্ম। আউল শব্দের অর্থ স্রষ্টার একান্ত সেবক । হিন্দী শব্দ বাউর ( বায়ুরোগগ্রস্ত) এর থেকেও বাউল শব্দের উৎপত্তি হতে পারে।
মূলত পরমাত্মার প্রেমে মাতোয়ারা এবং বাহ্যিক ব্যাপারে উদাসীন ব্যক্তিকে বাউল বলে। বাউল একটি সাধন ধর্ম। বাউলের চরম লক্ষ্য ‘মনের মানুষের সাথে মিলন’।বাউলগানের শ্রেণীবিন্যাস দুই প্রকার – (১) রাগ, (২) প্রবর্ত। ইষ্টের প্রতি নিবেদিত প্রেমের প্রগাঢ় ও পরিপক্ব অবস্থার নামই ‘রাগ’।
সাহিত্যের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি । এর উৎস ভাব। সাধক লালনের প্রতিভা গীতিকবির । লালনের গানের চিরন্তনতা সাহিত্যের একটা বড় উপাদান। এই গানের ভাষা অনেকটা চর্যাপদের সান্ধ্যভাষার মত। নিরক্ষর লালনের ভাষার সৌকর্য, সুরের বিস্তার , শিল্পের নৈপুণ্য তাঁকে ভাষার নিপূণ কারিগরের দক্ষতা দিয়েছে। শব্দ প্রয়োগের নৈপূন্যে আটপৌরে শব্দ ও হয়ে উঠে অপূর্ব ব্যাঞ্জনাময়। ভাব – ভাষা, ছন্দ – অলঙ্কার বিচারে লালনের গান উচ্চাঙ্গের শিল্প নিদর্শন।
লালনের গানে তৎসম শব্দের উপযুক্ত ব্যবহার বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। বাংলা শব্দে আরবী, ফারসি শব্দের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ইংরেজি প্রয়োগ ও দেখা যায় তাঁর গানে। লালন তাঁর গানে সমার্থক শব্দের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহারে বিশেষ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। —–
(ক) বাড়ির পাশে আরশি নগর(খ) আয়নামহল তায় (গ) জানো না মন পারাহীন দর্পন।
লালনের গানে ছন্দ আপন স্বভাবে গতি পেয়েছে। —
” আছে যার মনের মানুষ , মনে সে কি জপে মালা
অতি নির্জনে বসে বসে সে দেখছে খেলা। “
উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার।—-
” মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন
লুকালে না পায় অন্বেষণ
কালারে হারিয়ে তেমন
ও রূপ হারিয়ে স্বপনে। “
“এক নিরিখ দেখ ধনি , সূর্যাগত কমলিনী
দিনে বিকশিত কমলিনী , নিশিথে মুদিত রহে। “
বাউল গানের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে লালনের গানেও অনিবার্য ভাবে রূপক এসেছে। —
” লাগল ধুম প্রেমের থানাতে
মনচোরা পড়েছে ধরা রসিকের হাতে। “
লালনগীতিতে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবাদ – প্রবচন —
(১) কাক মারিতে কামান দাগা।
(২) পিঁড়েয় বসে পেড়োর খবর।
(৩) হাওয়ায় চিড়ে, কথার দধি , ফলার হচ্ছে নিরবধি।
অনুপ্রাসের ব্যবহার —–
(১)গুরু তুমি তন্ত্রের মন্ত্রী
গুরু তুমি মন্ত্রের মন্ত্রী
গুরু তুমি যন্ত্রের মন্ত্রী
না বাজাও বাজবে কেনে।
(২) ধর রে অধর চাঁদরে, অধরে অধর দিয়ে।
(৩) কারুণ্য , তারুণ্য এসে লাবণ্যে যখন মিশে।
এই তো গেল ভাষার সৌন্দর্য, লালনের গানে পৌরানিক কাহিনীর অনেক চরিত্রের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করি।
“ব্রহ্ম, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, রাধা, শ্যাম , শ্রীদাম , চন্দ্রাবলী , হরি, শচী, ব্রজ , গোপী , অর্জুন, সুভদ্রা , অভিমন্যু , যশোদা , অক্রুর, লক্ষী, কংশ, গোপাল, নারায়ণ , শম্ভু, দেবকী। পাশাপাশি পৌরাণিক স্থান মথুরা, বৃন্দাবন , গোকুল, অযোধ্যা দৃশ্যপট রচনায় অনন্য ভূমিকা রাখে।
মরমীয়াবাদ – তীব্র মিলনাকাঙখাই মরমীয়াবাদের মর্মকথা।
” মিলন হবে কতোদিনে
আমার মনের মানুষের সনে। “
যুক্তিবাদী লালন —
” আরবীতে বলে আল্লাহ
পারসিতে কয় খোদাতায়ালা
গড বলিছে যীশুর চেলা
ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভাবে। “
আধুনিক জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাখ ও একই যুক্তি দেন —
“God does not create man but has created God. “
কর্মবাদী লালন —
” না জেনে করণ কারণ
কথার কি হবে
কথায় যদি ফলে কৃষি
তবে কেন বীজ রোপা
গুড় বললে কি মুখ মিষ্টি হয়
দীপ না জ্বেলে কি আঁধার যায়। “
মিথ্যের প্রতি সততই বিদ্রোহী লালনের অনেক গানে এই সত্য উচ্চারিত হয়–
” সত্য বল, সুপথে চল
ওরে আমার মন। “
নিজ ভাষার প্রতি প্রেম—
” বাংলা শিক্ষা করো মন আগে
ইংরেজি মন তোমার রাখ বিভাগে
বাংলা না শিখিয়ে ইংরেজিতে মন দিয়ে
লালন বলছে করছো পাশের ভাবনা।”
স্বশিক্ষিত লালনের শিক্ষার ব্যাপ্তি —
(১) চেতন গুরুর সাথে কর ভগ্নাংশ শিক্ষা
বীজগণিতের পূর্ণনাম তাতে পাবে রক্ষা। “
(২) “মনের ভাব প্রকাশিতে
ভাষার সৃষ্টি এ জগতে। “
বাউল দর্শন :
বাউল সাধনার অন্যতম স্তম্ভ স্বরূপ থেকে অরূপে পৌছাতে আরোপ সাধনা। এই সাধনায় একজন বাউল কামনা – বাসনার উরধে থাকে। জীবন ও জগতকে দেখে নির্মোহ দৃষ্টিতে ।
” সাপের মুখেতে ভেকেরে নাচাবি
তবে তো রসিক রাজ। “
এটাই বৈষ্ণব রসিক রাজের লক্ষণ । শৈবগণ এই দশাকে শবসাধনা বলে। ধর্ম সম্পর্কে লালন ছিলেন সমন্বয়বাদী। তাঁর মানসগঠনে বৌদ্ধ সহজিয়া , বৈষ্ণব , লোকায়ত ধর্মসহ, ইসলামি সুফীবাদের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন :
বেদ – ” বেদ পড়ে ভেদ পেতো যদি সবে
গুরুর গৌরব থাকতো না ভবে। “
বৈষ্ণবকথা –
” আর কতোকাল আমায় কাঁদাবি
ও রাই কিশোরী । “
সুফীবাদ –
” আপনার আপনি হলে ফানা
দেখা দেবেন সাঁই রাব্বানা। “
তন্ত্রশাস্ত্র-
” যে আছে ষড়দলে
সাধু তারে উল্টোকলে
যদি সে সাধন বলে যায় দ্বিদলে।”
রামায়ণ –
” অহল্যা পাষাণী ছিল
সেও তো মানব হোল। “
শ্রীচৈতন্য –
” আর কি গৌড় আসবে ফিরে। “
সংসারত্যাগী ক্ষেপা-
” ক্ষেপা না জেনে তোর আসল খবর যাবি কোথায়। “
চর্যাপদ ও লালনঃ
চর্যাপদ এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। চর্যাপদ বৌদ্ধ ধর্মের এক বিশেষ শাখা সহজযানী সাধকদের রূপকাশ্রিত সংগীত। দেহই যার সাধন ক্ষেত্র, গুরুবাদী দর্শন। বাউল ও দেহবাদী – গুরুবাদী মোক্ষ সাধনা। পার্থক্য বাউলের পরম লক্ষ্য ” মনের মানুষের সাথে মিলন।”
মানবমুক্তির একটি নৈতিক পদ্ধতির কথা লালন এইভাবে বলেছেন-
” হিংসা , নিন্দা , তমঃ, ছাড় / মরার আগে মর / তবে হবে ভবপার। “
বৌদ্ধ মতাদর্শের আদিকথা এটাই।
চর্যাপদের পদকার লুই পা বলেছেন –
” গুরু পুছিঅ জাণ।”
লালন বলেছেন- “গুরুচরণ অমূল্য ধন।”
কাহ্নপার দাবী – ” সদগুরুর বচনকে প্রামাণ্য মেনে নিয়ে মনতরু কেটে এবং মায়ামোহ কেটে উত্তীর্ণ হতে হবে। “
লালন বলেন-
” গুরুকে ভজনা করো মন, ভ্রান্ত হয়ো না। “
বৌদ্ধ সাধনার আরেকটি পারিভাষিক চুরাশি । চুরাশিবার জন্ম , চুরাশি আঙ্গুলবিশিষ্ট মানবদেহ, চুরাশিজন সিদ্ধ পুরুষ।
লালন বলেন –
” ঘুরতে বুঝি হলো রে মন / এবার চুরাশি।
ভূসুকপা লিখেছেন – ” রাজ সাপ দেখি জো চমকিই
সাচে কিতা বোড়ো খাহ। “
লালন এটাকে আত্মীকৃত করেছেন এইভাবে – ” কলার ডেগো সর্প হলো।”
লুইপার দার্শনিক উক্তি —
” উদক চান্দ জিম। সাচন মিছে। “
জলের চাঁদ যেমন না সত্য না মিথ্যে।
লালন বলেছেন –
” জলে যেমন চাঁদ দেখি
ধরতে গেলে সকল ফাঁকি। “
চর্যাপদ যেভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছিল লালনের পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না তার পাঠোদ্ধার করা। নিঃসন্দেহে ভাবুক – মরমীদের সাধনা ও চিন্তনের ধারাবাহিক বহমানতা লালন উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন।
লালন সম্পর্কে প্রচলিত মত তিনি নিরক্ষর ও অশিক্ষিত। ” মহাত্মা লালন ফকীর ” নামে হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে নিবন্ধকাত উল্লেখ করেছেন, ” নিজে লেখাপড়া জানতেন না কিন্তু তাঁহার রচিত অসংখ্য গান শুনে তাহাকে পরম পন্ডিত মানতে হয়। তিনি কোন শাস্ত্রই পড়েন নাই ; কিন্তু ধর্ম্মালাপে বিলক্ষণ শাস্ত্রবিদ বলিয়া বোধ হইবে। “
লালনের দর্শন মানুষের মুক্তির দর্শন। এতে রয়েছে আত্মিক মুক্তির অধ্যাত্মবাদ, তেমনি সামাজিক মুক্তির জন্য রয়েছে মানবতাবাদ বা বস্তুবাদ। লালনের দর্শন সব ধর্মের , সব দেশের , সব মানুষের মুক্তির দর্শন , বিশ্বমানবতার দর্শন।