” ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা “। আমাদের অতীত একসময় অসামান্য সমৃদ্ধাশালী ছিল , তখন সোনার গাছে হীরের ফুল ধরত এইরকম সমৃদ্ধ একটা কিংবদন্তি ছিল। আসলেই কি তা বাস্তব নাকি স্বপ্ন ছিলো ? নাকি নিঃস্বতাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা থেকেই এর জন্ম। গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, মাঠভরা ধান এদেশবাসীর ছিলো কোনকালে ?
পাথরের হাতিয়ার,মানব সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন। পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া, মেদেনীপুর ও বর্ধমান জেলায় প্রাগৈতিহাসিক পাথরের হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়েছে। ঐতিহাসিকদের ধারণা প্রায় দশ হাজার পূর্বে বাংলায় এই হাতিয়ার ব্যবহারকারী বসতি স্থাপন করে। যদিও তা যথার্থ অনুমান নয়। অস্ট্রো – এশীয় অনার্য লোকেরা
‘ নিষাদ ‘ নামে পরিচিত এদেশের আদি বাসিন্দা । আজকের কোল, ভিল, সাঁওতাল , শবর, পুলিন্দ আদিবাসীরা তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে , পূর্ব ও উত্তর বাংলায় বহু পূর্ব থেকেই বাস করতো মঙ্গোলীয় বা ভোট চীনা গোষ্ঠীর লোক। এরা হলো গাড়ো, চাকমা, কোচ, টিপড়া, মেছ, কাছাড়ি। এদের বলা হতো কিরাত জাতি। এরপর ভূমধ্যসাগর অঞ্চল থেকে আসে দ্রাবিড় জাতি। যারা ছিল সুসভ্য এবং বাংলায় নগর সভ্যতার পত্তনকারী।
খ্রীষ্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে আর্যরা পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাংলায় প্রবেশ করে। সমগ্র বাংলা আর্যায়িত করতে প্রায় একহাজার বছর সময় লাগে। শিকার, পশুচারণ ও কৃষি অনার্যদের উপজীবিকা ছিল। আর্য সভ্যতা গ্রামকেন্দ্রিক । অর্থনীতির মূল ভিত্তি
কৃষি। ঋক বৈদিক যুগে পশুচারণ ছিল প্রধান উপজীবিকা। ধনী ব্যক্তিকে বলা হতো ‘ গোমৎ ‘। ‘ গো – অপহরণ নিয়ে আর্য – অনার্যদের মধ্যে বিরোধ ও বিবাদ লেগেই থাকত।
প্রাচীনকালে উর্বর জমি, অনুকূল জলবায়ু জন্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। কৃষির প্রসারের আর একটি কারণ লোহার ব্যবহার। পাট , ইক্ষু , তুলা , সর্ষে , নীল , পান ছিল উৎপাদিত পণ্য। এলাচি, তেজপাতা, লবঙ্গ প্রভৃতি মসলা ও উৎপন্ন হত। প্রতিটি গ্রাম ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ । মাটির তৈরি তৈষজপত্র , লোহার তৈরি দা, কুড়াল, লাঙ্গল , জলের পাত্র, বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র তীর, বর্শা ও তলোয়ার তৈরি হত । বিলাসিতার জন্য স্বর্ণ ও মণি – মাণিক্যের অলঙ্কার শিল্প অনেক উন্নতি লাভ করে। কাঠের তৈরি আসবাবপত্র , ঘর – বাড়ি, মন্দির, পালকি , গরুর গাড়ি ও রথ , নদী ও সমুদ্রে চলাচলের জন্য নৌকা তৈরি হতো। বস্ত্রশিল্পে বাংলার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া । মসলিন , রেশমী কাপড় , মোটা সুতি কাপড় তখন প্রস্তুত হতো। সেসময় বঙ্গদেশে টিন পাওয়া যেত। বারুদ তৈরির উপাদান ‘ শোরা ‘ পাওয়া যেত দক্ষিণ বিহারের লালগঞ্জ জেলায় ।
বাংলায় কৃষি ও শিল্পদ্রব্যের প্রাচুর্য ছিল এবং এগুলোর চাহিদা ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। শিল্পের উন্নতির সাথে সাথে স্থল ও জলপথে বাণিজ্য প্রসার লাভ করার কারণে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বড় বড় নগর ও বাণিজ্য বন্দর গড়ে উঠে । এগুলো হলো – নব্যাবশিকা , কোটিবর্ষ , পুণ্ড্রবর্ধন , তাম্রলিপ্ত , কর্ণসুবর্ণ , সপ্তগ্রাম ইত্যাদি।
সমুদ্রেপথে সিংহল , মালয় , ব্রম্মদেশ , চম্পা , শ্যাম , সুমাত্রা , চীন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় হত।
স্থলপথে চীন , নেপাল, ভূটান , তিব্বত ও মধ্য এশিয়া প্রভৃতি দেশ। খ্রীষ্টপূর্ব চার শতকের পূর্বে বাংলায় মুদ্রার প্রচলন হয়। কড়ি সবচেয়ে কম মান হিসেবে ব্যবহৃত হত।
আর্য সমাজের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শর্ত হলো জাতিভেদ। সমাজের উঁচুশ্রেণী বা ব্রাম্মণদের হাতে ছিল মূল ক্ষমতা । সপ্তম শতাব্দিতে হিউয়েন। সাঙ এর বিবরণ আর বাণভট্টের ‘ হর্ষচরিত ‘ গ্রন্থে কৃষি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। গুপ্ত যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ” তাম্রপট্ট দ্বারা অগ্রহার জমি প্রদান ” রাজা বা জমিদার কতৃক পূণ্যার্থে ব্রাম্মণ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে করমুক্ত জমি দান। দান গ্রহিতা এইসব জমি চাষ করতো না, কৃষককে চাষের জন্য নিযুক্ত করা হত। এই ব্যবস্থায় দান গ্রহিতা মধ্যধিকারীগণ যথেষ্ট প্রভাব, প্রতিপত্তির অধিকারী হন। জমির মালিক স্বামী , কৃষক অর্থে চাষীকে বোঝানো হতো।
ভিনসেন্ট স্মিথের মতে , রাজাই ছিলেন সমস্ত জমির মালিক। বোধায়ন ধর্মসূত্র , কোটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির কথা উল্লেখ আছে। তবে তাদের কর দিতে হত। অধিকাংশ জমির আয়তন ছিল ছোট , চাষী ও তার পরিবার চাষবাস করত । তাদের জীবনযাত্রা ছিল কঠোর। জৈনসূত্রে কৃষি শ্রমিকের কথা জানা যায় , মৌর্য যুগে ভূমিহীন কৃষকের অস্তিত্ব ছিল। শারিরীক অসুস্থতা , দুর্ভিক্ষ , কর প্রদানে অক্ষম হলে কৃষক জমি বিক্রি করতে বাধ্য হত, নাহয় তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হত। ব্রাম্মণদের অত্যাচারে সাধারণ জীবন অতিষ্ট হয়ে পড়েছিল। সেন আমলে বৌদ্ধ সমাজে নেমে আসে দুর্দশা , সাধারণ হিন্দু সমাজ ও দূর্বল হয়ে পড়ে।
বহির্বাণিজ্যের ক্রমোন্নতিতে মুঘল আমলে বাংলায় টাকা ও শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি পায় । তবে শ্রমের এই মূল্য বৃদ্ধিকে দ্রব্যমূল্যের নিরিখে প্রকৃত মজুরি বলা যায় না। এরফলে ধনী আরো ধনবান হয়ে উঠে, সরকারি কর্মচারী ও দালাল শ্রেণীর লোকেরা অঢেল ধন – সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠে। প্রাকৃত জন থাকে উপেক্ষিত।
ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়েছে ভূমি সম্পর্ক ও গ্রামীণ সমাজ কাঠামোয়। গ্রামীণ সম্পদ ভূস্বামীর হাতে পুঞ্জিভূত হলো , প্রজা হলো চির ঋণগ্রস্থ , অসহায়, দূর্বল শ্রেণী। অর্থের অভাবেই শিক্ষাবঞ্চিত , স্বাভাবিকভাবেই পশ্চাদপদ।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য যারা পড়েছেন, তাঁরা জানেন কি অপরিসীম দারিদ্র ও দুঃখ কষ্টের ছবিতে আকীর্ণ এর বাস্তবতা। বাংলা সাহিত্যের প্রথম বই চর্যাপদে টেন্টন পা’ র কবিতা,
” টালট ঘর মোর নাহি পড়বেসি।
হাঁড়িতে ভাত নাহি নিতি আবেষি।
হাঁড়িতে ভাত নেই তাই কবিকে নিত্য উপবাসী থাকতে হয়। এই দারিদ্রের ছবি আছে কবি মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে। বারমাইস্যার প্রতিটি মাস ফুল্লরাকে কি নিদারুণ কষ্টে পার করতে হয়। এই দুঃখ – কষ্টের চিত্র পরতে পরতে রয়েছে ময়মনসিংহ গীতিকা আর পূর্ববঙ্গ গীতিকার সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। বার শতকে সেন রাজার সভাকবি গোবর্ধন আচার্য তাঁর ‘ আর্যাসপ্তশতী ‘ কাব্যগ্রন্থে বাংলার সামাজিক জীবন, বিশেষ করে নারীদের জীবন – কিভাবে নারীরা বহুগামী ও যৌথ পরিবারে বাস করত, তাদের দুঃখ , বিলাপ ও স্বামীর উপর পূর্ণ নির্ভরতা এবং তাদের দৈনন্দিন জীবন বিধৃত হয়েছে।
কখনো পালেরা শাসন করেছে , কখনো সেন , পাঠান , মোগল, ব্রিটিশ , পাকিস্তান। এই যুগ যুগের দাসত্ব আমাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে এতোটাই ভেঙ্গে দিয়েছে ও আমাদের হীনমণ্যতা আর স্বার্থপরতার প্রবণতাকে এতোটা স্থায়ী করে দিয়েছে , যা আমাদের আজকের অগ্রগতিতে বড় বাঁধা হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও প্রযুক্তির এই অগ্রগতির যুগে যে দেশ ” সবার জন্য খাদ্য ” এই নিশ্চয়তা দিতে পারে না, সেখানে মধ্যযুগের অন্ধকার ও অসহায়ত্বের দিনে সেই দেশ কোন জাদুর ছোঁয়ায় সমৃদ্ধি পেয়েছিল, যাদের দ্বিমত আছে এই বিষয়ে প্রশ্নটা রাখলাম তাঁদের কাছে।
লেখক ঃ ফাতেমা জোহরা