১.
ভরা চৈত্র মাস। প্রবল তাপদাহে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। দুইমাস যাবত বৃষ্টি নাই। মাঠের ফসল পুড়ে গেছে। জনজীবন দূর্বিসহ হয়ে উঠেছে। এহেন পরিস্থিতিতে কুসুমপুরের মানুষ এক আজব লীলা দেখল। বলা নেই, কওয়া নেই মেঘ ছাড়াই আসমান থেকে পানি পড়া শুরু হলো। অঝোর ধারায় বর্ষিত হয়ে কুসুমপুরের মাঠঘাট পানিতে একাকার করে দিলো। খোদার এই লীলা দেখতে সবাই জড়ো হয়েছে সলিম মাতবরের খানকা ঘরে। সলিম মাতবর এলাকার অঘোষিত সম্রাট। এখানকার সবকিছুই উনার কথামতো হয়। মাতবরের হুকুম ছাড়া কুসুমপুরের একটা গাছের পাতাও নড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম লীগ করত। সে সময় ম্যালা টাকা–পয়সা কামিয়ে নিয়েছে। এখন আওয়ামীলীগ করে। শেখ সাহেবের সাথেও নাকি মাঝে মাঝে দেখা করতে যায়। চৈত্র মাসে অকাল বর্ষা দেখে সলিম মাতবরও টাসকি খেয়ে যায়। ফজলুকে ডাক দেয় মাতবর। ফজলু সলিম মাতবরের ডান হাত। সব আকাম–কুকামের পরামর্শ দাতা। ফজলুকে ডাকতেই ছুটে আসে ফজলু।
–কত্তা ডাকলেন নাকি?
– হ। ডাকলাম তো। যা ইমাম সাহেবকে খবর দে। এই অসময়ে এমুন বর্ষণ তো আমি বাপের জন্মে দেখিনি।
–আজ্ঞে কত্তা। তয় এখকান কথা আছিল।
–কি কথা?
–কত্তা কাল রাতে নদীর ঘাটে দক্ষিন পাড়ার নূরুর মেয়েকে কারা যেন মাইরা রেখে গেছে। আর তখন থেকেই নাকি এই ঝড়–বৃষ্টি শুরু হইছে।
–কস কি! নূরুর মেয়ে মানে বাসন্তী?
–হ কত্তা।
সলিম মাতবরের মনে পড়ে যায়, যুদ্ধের পরপরই বাসন্তী নামের ওই মেয়েটি মাতবর বাড়িতে কাজ করত। খুব সুশ্রী মেয়ে। গায়ে–গতরে দেখতে বেশ চমৎকার। টাকার লোভ দেখিয়ে কয়েকবার বিছানায় নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। খুব জেদি আর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মেয়ে ছিল। তারপর একদিন জোর করে গায়ে হাত দিছিল। তারপর থেকে আর কামে আসেনি। সেও তো প্রায় বছর তিনেক আগের কথা। এর মাঝে আর মেয়েটিকে তেমন দেখা যায়নি। শোনা যায় পাশের গাঁয়ে খালার বাড়িতে থাকত।
২.
ইমাম সাহেবকে ডাকতে হয় না আর। তিনি না ডাকতেই চলে আসেন। এখলাস মোল্লা। ইমাম সাহেবের নাম। তিনি অনেকদিন হলেই এই গাঁয়ের মসজিদের ইমাম সাহেব। তিনি কোন মাদরাসা থেকে পড়াশোনা শিখেছিলেন তা কেউ জানে না। কারণ কুরআন শরীফটাও নাকি তিনি ঠিক মতো পড়তে পারেন না। তবে কথায় কথায় ফতোয়া জারি করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। অবশ্য বেশিরভাগ ফতোয়া গুলোই তিনি সলিম মাতবরের সুবিধার জন্য জারি করে থাকেন।
ইমাম সাহেব আসতেই সলিম মাতবর তাকে জিজ্ঞেস করেন,
–হুজুর কিছু শুনেছেন?
–শুনলাম তো একটুখানি। নূরু মিয়ার ব্যাভিচারিনী মেয়েটা নাকি মরে পড়ে আছে।
–তো এখন কি করা যায়?
–নূরু মিয়াকে গ্রাম থেকে বহিষ্কার করা হোক।
সাথে সাথে ফরমান জারি হয়ে যায়। নূরু মিয়াকে সপরিবারে গ্রাম থেকে বহিষ্কার করা হয়। সলিম মাতবরের হুকুম তো মানতেই হবে।
৩.
সবুজ–শ্যামলে ভরা কুসুমপুর গ্রাম। গাঁয়ের পাশে দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা নদী। আর সেই নদীর পাশেই পড়ে ছিল বাসন্তীর লাশ। নিম্নাঙ্গ ছিল রক্তাক্ত। তয় মুখের কোন পরিবর্তন হয়নি। বুকে, পাজরে গভীর ক্ষতের চিহ্ন থাকলেও মুখটা ছিল একদম অক্ষত। ঠোটের কোনে ঝুলছিল এক চিলতে হাসি। বাসন্তীর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল রুপম। রুপম কুসুমপুরের ফরিদ মাষ্টারের ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বাসন্তীকে খুব ভালবাসতো ও। আর বাসন্তীও। বাসন্তীকে কারা যেন ধর্ষন করে মেরে রেখে গেছে। ওর ভালবাসার মানুষটি ওর সামনে নিথর হয়ে শুয়ে আছে। আচ্ছা ওরা যখন বাসন্তীকে রেপ করছিল তখন বুঝি বাসন্তীর খুব কষ্ট হচ্ছিল? ও আস্তে আস্তে গিয়ে বাসন্তীর মাথাটা কোলে তুলে নেয়। বৃষ্টির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় ভেসে ওঠে বাসন্তীর হাজারো সৃত্মিময় মূহুর্তগুলো। একে একে মনে পড়ে অসংখ্য স্মৃতি।
সময়টা ১৯৭৪ সাল। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটা দেশ। সবকিছুই অগোছালো। শেখ সাহেব আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছেন দেশটাকে গুছিয়ে নিতে। অন্যদিকে আরেকটা দল চাচ্ছে দেশটাকে আরও পিছিয়ে দিতে। আর মাঝখান থেকে আরেকদল মানুষ দেশের সবকিছু লুটেপুটে নিয়ে নিজের আখের গোছাচ্ছে। তখন তো দেশের বেশির ভাগ মানুষই অশিক্ষিত। আর শিক্ষিত যারা ছিল তাদের কে যুদ্ধের সময় পাক–বাহিনী জামা’আতে ইসলামের সহযোগিতায় মেরেই ফেলেছে। শেখ সাহেব দরাজদীল মানুষ। কিন্তু সেই সময় দেশ শাসনে অনেক কঠোরতা প্রয়োজন ছিল। তিনি এই কারণে নিজের দলীয় লোকজন ও আত্মীয় স্বজনের উপর তেমন একটা নিয়ন্ত্রন রাখতে পারলেন না। আর যার কারণে দেশে লুটপাটের মোচ্ছব শুরু হয়ে গেল। আর দেশে এসে গেল সেই ভয়াল দূর্ভিক্ষ। হাজারো সতী সাধ্বী মা বোনেরা হয়ে গেল বাসন্তী। কুসুমপুরও সেই ভয়াল দূর্ভিক্ষের করালগ্রাস থেকে রক্ষা পেল না।
অনেক অনেক দিন আগে সরদার বাকের মোল্লা নামে এক লোক এই গ্রামের পত্তন করেছিল। কুসুমপুর তখন ছিল ধু ধু ফাকা প্রান্তর। ভারতের ছত্রিশগড়েরর জমিদার পুত্র বাকের মোল্লা ভাইদের উপর অভিমান করে সন্তানসম্ভবা বউ কে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। নানা জায়গায় ঘুরে শেষে বাংলাদেশে এসে পৌছে। একদিন এই কুসুমপুরের উপর দিয়ে কোথাও এক জায়গায় যাচ্ছিল ওরা। পথের মাঝে সন্ধ্যা হওয়ায় একটা গাছের নিচে তাবু খাটিয়ে রাতে থাকার ব্যবস্থা করে। আর খোদার কি লীলা! সেই রাতেই বাকের মোল্লার স্ত্রী কুসুমবানু একটা পুত্রের জন্ম দেয়। পুত্রের মুখ দেখে খুশি হয়ে বাকের মোল্লা এইখানেই বসত ভিটা করা স্থির করে। কাছে থাকা জমানো টাকা–পয়সা দিয়ে খড় ছন কিনে বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করে। আর নিজের প্রিয় স্ত্রীর নামে এ গাঁয়ের নামকরণ করে কুসুমপুর। এভাবেই এই কুসুমপুর গাঁয়ের পত্তন হয়।
৪.
বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কথা শুনে বিশ্বেও বিভিন্ন দেশই সাহায্য পাঠাচ্ছিল। অনেক ত্রান এসে জড়ো হয়েছিল রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। বিদেশ থেকে আসা রিলিফ সামগ্রী বিলি করার উদ্দেশে সরকার দলীয় নেতা–কর্মীরাই সর্বত্র রিলিফ কমিটি গঠন করে। শুরু হয় ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, গরিব কৃষক ও ভূমিহীন মজুরদের অনেকেই না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিল। ধার দেনা করে এমনকি হাট থেকে সিদ্ধ মিষ্টি আলু কিনে একবেলা খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছিল তাদের অনেককেই। জাতীয় সংবাদপত্র খুললে প্রথমেই চোখে পড়ত খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খবর। পেটে যখন ভাত নেই তখন লাখ লাখ টন বিদেশী সাহায্যে নির্বিবাদে পাঁচার হয়ে যাচ্ছিল সীমান্তের ওপারে। গ্রাম থেকে এসে কৃষক–মজুরেরা ভিক্ষার জন্য শহরের মানুষের কাছে হাত পাতে। ফিরে যায় ভিক্ষা না পেয়ে। তারপর বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রতিদিন ঢাকা শহর থেকেই তিরিশ থেকে চল্লিশটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছিল। মাছধরা জাল পরে লজ্জা নিবারণ করছিল গৃহবধুরা।
অনেকের মত কুসুমপুরের নুরু মিয়ার পরিবারেও নেমে এসে দুর্ভিক্ষের কোপ। একদিকে সলিম মাতবরের অত্যাচার অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ। তারপরও কোন মতে দিন কাটাচ্ছিল ওরা। কিন্তু‘ গত কয়েকদিন হলো নুরু মিয়ার শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। আজ দুইদিন হলো ঘরে কোন খাবার নেই। বাসন্তীর ছোট ছোট ভাইবোনগুলো ক্ষিধের জালায় ছটফট করছিল। কাঁদতে কাঁদতে নেতিয়ে পড়েছিল। উপায়ন্তর না দেখে ঠোঁটে লিপিস্টিক মেখে সন্ধ্যার পর নদীর ঘাটে দাড়ায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সবার ঘরে ঘরে অভাব লেগে আছে। একমুঠো খাবারের লোভে অনেক নারীই এখন দেহব্যাবসা করে। বাসন্তীর অনেক বান্ধবীই চুরি করে এসব করে।
ঘরে অসুস্থ’ বাবা আর ছোট ছোট ভাইবোনগুলোর কষ্ট সহ্য করতে না পেরেই ও এই সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে সলিম মাতবর সহ অনেকেই টাকার বিনিময়ে ওকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে। ও কখনই রাজি হয়নি। কিন্তু‘ আজ উপায়ন্তর না দেখে ও দেহ বিক্রি করতে নদীর ঘাটে এসে দাড়ায়।
নদীর পাড়ে ছাতিম তলায় এসে দাঁড়ায় ও। এদিকটায় অন্ধকার একটু বেশি। ও দাঁড়িয়ে আছে শরীর বেচার অপেক্ষায়। শরীর বিক্রি করা টাকা নিয়ে গিয়ে ও ভাইবোনদের মুখে খাবার তুলে দেবে।
নদীর পাড়ের ঠান্ডা হাওয়ায় মনটা অনেক উতলা লাগছিল। বারবার রুপমের কথা মনে হচ্ছিল। এই নদীর ঘাটেই ও রুপমের সাথে কত খেলা করত। বড় হওয়ার পর রুপমের সাথে কথা বলত না ঠিকই কিন্তু‘ দুর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত। খুব ভালবাসত ও রুপম কে। কিন্তু কখনও ভালবাসার কথা রুপম কে জানায়নি। অনেক কথাই ভাবছিল ও। এমন সময় একজন লোক এসে ইশারা দেয়।
–হইব নাকি?
–হুমম।
–কত নিবা?
–১০০ টাকা।
একশ টাকাই তখন অনেক ছিল।
লোকটি তখন একহাতে বাসন্তির চিবুক ঘরে মুখটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখে বলে,
–চেহাড়া সুরত তো ভালই। এ লাইনে নতুন নাকি?
–হুমম। মাথা নাড়ে বাসন্তি।
লোকটি বাসন্তি কে নিয়ে একটু নির্জন জায়গায় যায়। তারপর ঘাসের উপর শোয়ায়ে ঝাপিয়ে পড়ে ওর শরীরের উপর। যৌনাঙ্গ থেকে ছিটকে পড়ে কয়েকফোঁটা রক্ত। ও বেশ্যা হয়ে যায়।
কাজ শেষ করে লোকটা ওর হাতে একশ টাকার একটা নোট গুজে দেয়। ও কাপড় ঠিক করে হাটতে থাকে। এই টাকা দিয়ে অনেক কয়দিন খুব ভাল করে খাওয়া যাবে। কারণ একশ টাকা তো অনেক টাকা। ওর নিজের উপর খুব ঘৃনা হয়। সারা শরীরে আজ ওর পাপ লেপটে আছে। ও এখন বেশ্যা। পাপী।
খুব করে রুপমের কথা মনে হয়। আকাশের দিকে তাকায় একবার। আকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে। ও হাটতে থাকে। কিছুদুর যাওয়ার পর হঠাৎ কয়েকজন যুবক ওকে ঘিরে ধরে।
তারপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। একসময় ওদের কামনা চরিতার্থ করে ওরা চলে যায়। ঘাসের উপর অচেতন পড়ে থাকে বাসন্তি। ঘাসের উপর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে রক্ত। একবার হুশ ফিরে আসে। ও আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে তখন বড় একটা চাঁদ। চাঁদের আলোয় ও নিজের শরীরটা একবার দেখে নেয়। শরীরের উপর খুব ঘৃনা হয় ওর। পাপে মনে হয় শরীরটা ভারী হয়ে আছে। ও আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
–আল্লাহ জীবনে তো আর কোন পাপ করিনাই। জীবনের এই শেষ মূহুর্তে তুমি আমার পাপগুলোকে ধুয়ে দাও। ও আকাশের দিকে তাকিয়েই থাকে। ভরা চৈত্র মাস। কিছুক্ষন পর বৃষ্টি নামে। ওর চোখে খুশির ঝিলিক দেখা দেয়। বৃষ্টি এসেছে। এবার ওর সব পাপ ধুয়ে যাবে। বৃষ্টির প্রবল ধারা ওর শরীর স্পর্শ করে। ওর সব পাপ দুর হয়ে যায়। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে বাসন্তি। চৈত্রের অকাল বর্ষণ বাড়তেই থাকে। আর সেই বর্ষণে বাসন্তীর পাপমোচন হয়।
লেখকঃ জাকওয়ান হুসাইন