বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু শক্তিকেন্দ্র তৈরির চুক্তি সম্পন্ন করেছে। রূপপুর পরমাণু শক্তিকেন্দ্র নামে এ প্রকল্পটি শুরু থেকেই নানা কারণে বিতর্কিত। এই প্রকল্পের পটভূমিতে আসছে চেরনোবিল পরমাণু দুর্ঘটনার কথা। ৩০ বছর আগে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনাকে এখন পর্যন্ত মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম পরমাণু দুর্ঘটনা ধরা হয়।
২৬ এপ্রিল ১৯৮৬। চেরনোবিলের রিঅ্যাক্টর দুর্ঘটনা ঝুঁকি প্রতিরোধের সব বাঁধ ভেঙে চুরমার করে দিল। ৩০ বর্গমাইল এলাকার সাড়ে ৮ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হলো। কয়েক বছর ধরে ৩ থেকে ৬ লাখ লিকুইডেটর (বিকিরণ পরিষ্কারকর্মী) পাঠানো হলো চেরনোবিলে। অনেক দিন পর ২০০৬-এ আন্তর্জাতিক পারমাণবিক কমিশন সরাসরি মৃতের সংখ্যা ৯ হাজার বলে প্রকাশ করল। কিন্তু গ্রিন পিসের অনুসন্ধানে ক্যানসার এবং অন্যান্য জটিল রোগে আরও ৯৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর এসেছে। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট গরবাচেভ দুর্ঘটনার ১৮ দিন পর বেতার ভাষণ দিলেন।
আত্মপক্ষ সমর্থন বা লুকিয়ে রাখার কোনো সুযোগ আর ছিল না। সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের আকাশে-বাতাসে রঞ্জনরশ্মি বিপজ্জনক মাত্রা পেরিয়ে গেল। জার্মানির শিশুদের খেলার জায়গাগুলো থেকে টন টন বালু তুলে নিয়ে নিরাপদ এলাকায় স্তূপ করার ব্যবস্থা করা হলো। ট্রাকভর্তি নতুন বালু নিয়ে আসা হলো। লেখকের বড় ছেলে টুবিয়াস নাদিম, তার
বয়স ছিল মাত্র ৬, প্রায় এক মাস খেলতে বাইরে যেতে পারেনি। এই শুধু গোটিনগেনের অভিজ্ঞতা। জার্মানির বড় বড় সব শহরে
একই অবস্থা। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কোন শহরের কী অবস্থা কেউ জানতে পারেনি।
সম্প্রতি বার্লিনবাসী রুশ সাংবাদিক লেখিকা কাতিয়া পেত্রভস্কায়া তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই ফিলাইস্ট এসথার–এ লিখেছেন, ‘গ্রীষ্মে শহর শিশুমুক্ত, হাসি নেই, কোনো কিন্ডারগার্টেন নেই এবং কোনো গর্ভবতী মা নেই। চারদিকে যন্ত্র দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে তেজস্ক্রিয় ধুলা মুছে নিতে। বৃষ্টি হলেও যন্ত্রের পানি ছিটানো হচ্ছে।’ চেরনোবিলকে ৩০ বছর পর বলা হচ্ছে মৃত্যুকূপ। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন আবার নতুন করে এখানে কংক্রিটের ছাদ বসাচ্ছে। সোভিয়েত আমলে নির্মিত ছাদ রশ্মি নির্গমন হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারেনি। পারমাণবিক জ্বালানি দুর্ঘটনার পর চেরনোবিল পৃথিবী পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটাই সম্ভবত বড় স্বপ্নভঙ্গ। হিরোশিমার পারমাণবিক ধ্বংসলীলা ছিল সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতা। কিন্তু চেরনোবিল বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। যে দেশের পদার্থবিদেরা অণু-পরমাণু ভেঙে পারমাণবিক মহাশক্তির উদ্ভাবন করেছিলেন, সেই জার্মানি ঘুরে দাঁড়াল। জার্মানি আর নিউক্লিয়ার শক্তি উৎপাদন করবে না—এই রকম একটা সর্বদলীয় সংসদীয় সিদ্ধান্ত নিল।
জার্মানির যে গোটিনগেন শহরে ক্ল্যাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার জন্ম বলা হয়, সেই শহরের প্রায় সব পদার্থবিদ অটো হান, হাইজেনবার্গ, মাক্স বর্ন ও ফন ভাইজেকার শুরু থেকেই জার্মানির পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ১৯৫৭ সালে বিবৃতি দেন গোটিনগেনের ১৮ জন শীর্ষ পদার্থবিজ্ঞানী। এই বিবৃতি পরমাণু অস্ত্রের বিপক্ষে বিখ্যাত গোটিনগেন ম্যানিফেস্টো হিসেবে পরিচিত। তাঁরা জার্মান সরকারের গোপন পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্পের খোলাখুলি বিপক্ষে নামলেন। ১৯৮০–র দশকে পরমাণু বর্জ্যবিরোধী আন্দোলনেও গোটিনগেনের পদার্থবিদদের অংশগ্রহণ ছিল। এই বিজ্ঞানীরা কোনো দিন ঘটা করে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের পক্ষে প্রবন্ধ লেখেননি।
জার্মানির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা অনেক দিন পর অাঙ্গেলা ম্যার্কেলের নেতৃত্বে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট এবং গ্রিন পার্টির পারমাণবিক শক্তিবিরোধী আইন প্রণয়নে অংশ নিয়েছে এবং সমর্থন দিয়েছে। ২০২৪ সালে জার্মানির সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে। এই সিদ্ধান্ত বাধাহীন নয়। পরমাণু লবি অনেক ক্ষতিপূরণ চায়। তা ছাড়া, ওরা ধরে নিয়েছিল, জার্মানি বিকল্প শক্তির বিনিয়োগে সফল হবে না। অথচ ইতিমধ্যে বিকল্প শক্তি উৎপাদনে অনেক এগিয়েছে। নতুন পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, যেখানে পারমাণবিক শক্তি ১৪ শতাংশ, সেখানে শুধু বাতাস শক্তি, অর্থাৎ উইন্ড এনার্জি ১৩.৫ শতাংশ। জার্মানিতে পানি, সোলার ও বায়োগ্যাস মিলিয়ে বিকল্প শক্তি উৎপাদন এখন ২৪ শতাংশের কাছাকাছি। এখানে অবশ্য একটা ইউরোপীয় ব্যাপার রয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী ফ্রান্স এখনো ৭০ শতাংশ পারমাণবিক শক্তি দিয়ে চলে। এদিক থেকে ইতালি ইতিমধ্যে পরমাণু জ্বালানিমুক্ত। তবে এটা বলা যায়, উন্নত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো পরমাণু বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেওয়ার পথে রয়েছে।
ইউক্রেনের চেরনোবিল ও জাপানের ফুকুশিমার পরও পৃথিবী নীতিগত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছে বলা যাবে না। এখনো যুক্তরাষ্ট্র ১০০, ফ্রান্স ৫৮, জাপান ৪৩ ও রাশিয়া ৩৫টি পরমাণু শক্তিকেন্দ্র চালিয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগী ইউক্রেন চালাচ্ছে ১৫টা, অথচ জার্মানির সংখ্যা মাত্র ৮। নিউক্লিয়ার জ্বালানি শক্তি উৎপাদনের অন্যতম সমস্যা হলো, কোথায় নির্ভয়ে রাখা যাবে পারমাণবিক বর্জ্য। হাজার হাজার বছর এই বর্জ্য তেজস্ক্রিয় রশ্মি ছড়ায়। এই রশ্মি ক্যানসার রোগের কারখানা। পরমাণু দুর্ঘটনায় প্রতিবেশীরা নিরাপদ অবস্থানে থাকবে, এই যুক্তি অসার। বাতাসের কোনো পররাষ্ট্রনীতি নেই। বাতাসে গন্ধহীন এই আণবিক রশ্মির অনুপ্রবেশ ঘটলে সীমান্তরক্ষীরাও অসহায়।
আজকের পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন বিশ্বজনীন রূপ নিয়েছে। প্রায় ১৫০ বছর আগে জার্মান জীববিজ্ঞানী এর্নেস্ট হাকেল প্রথম ‘ইকোলজি’ শব্দ মুখে আনেন। আজ ‘ইকোলজি’ সবার মুখে মুখে। পরমাণু শক্তিবিহীন উন্নয়ন আজ অনেকের কাছে হয়তো গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের সামনে সতর্কতা হয়ে আছে চেরনোবিল বিপর্যয়। চেরনোবিল শহরটা মৃত্যুকূপের স্থিরচিত্র হিসেবে এখনো আছে। দরজা–জানালা খোলা রেখে তখন অনেক পরিবার পালিয়ে গিয়েছিল। তারা আর কেউ ফিরে আসেনি। কোনো দিন ফিরে আসবেও না। মানবজাতি জ্বালানি বিতর্কে নরক গুলজার করবে; তা হয় না। সময় কম। চোখের সামনে চেরনোবিল মৃত্যুকূপ উদাহরণ।
রূপপুরে পরমাণু শক্তিকেন্দ্রের পক্ষে যাঁরা, তাঁরা যেন চেরনোবিল ও ফুকুশিমার কথা মনে রাখেন। মনে রাখেন, বাংলাদেশ ছোট ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এবং এও মনে রাখেন, এ ধরনের কেন্দ্র চালানোর মতো দক্ষ লোকবল আমাদের নেই।
লেখকঃ সুজিত চৌধুরী
অর্থনীতিবিদ, সাবেক পরিবেশ উপদেষ্টা, জার্মান দূতাবাস, ঢাকা এবং বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য