৭ জুন হরতালকে কেন্দ্র করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ত্রাসের সৃষ্টি করা হয়। শ্রমিক কলোনিতে পুলিশি হামলা চলে। শ্রমিকরা ভয়ে তাদের বাসস্থান বেগুনবাড়ি, নাখালপাড়া ও মহাখালী ছেড়ে পালিয়ে যায়। রুহুল আমিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা হয়। আত্মগোপন অবস্থায় ‘৬৬ সালেই গ্রেপ্তার হন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের পর মুক্তি পান। তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

আজ ৭ জুন, সেই অতীত দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। কোথায় হারিয়ে গেলেন সেসব মানুষ, যারা তখন নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে দেশের জন্য লড়েছিলেন। নিজ প্রাপ্তির কথা কখনও ভাবেননি। ১৯৬৬ সালের এই দিনে ৬ দফা দাবিতে ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে হরতাল ডেকেছিল আওয়ামী লীগ। তেজগাঁও, ডেমরা, আদমজী ও পোস্তগোলা শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক ও ছাত্রলীগ সেদিন ছিল প্রধান ভূমিকায়। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তখন কারাগারে। যারা বাইরে ছিলেন তারা হয় আত্মগোপনে বা কেউ কেউ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন বা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। এক শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি পেশায় ছিলেন আইনজীবী, ৭ জুন ময়মনসিংহে আদালতে গিয়েছিলেন শুধু সরকারকে জানাতে যে, তিনি হরতালে অংশগ্রহণ করেননি।

হরতালের মূল সংগঠক ছাত্রলীগ ও কয়েকটি শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা। এই ভরসায় হরতাল ডাকা হয়। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন রসদ সংগ্রহের দায়িত্বে। হরতালে ছাত্রলীগের কাজে সহযোগিতার দায়িত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি ও মাজাহারুল হক বাকি। সেই সময়টায় ইউনিভার্সিটি ও কলেজ ছিল বন্ধ। হরতালে শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজটি করেন সিরাজুল আলম খান। তখন তার নামে হুলিয়া। ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির আহসানউল্লাহ হলে থেকে তিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ ও হরতাল সংগঠিত করছিলেন। হরতালে শ্রমিকদের অংশগ্রহণটাই আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে দেয়।

৭ জুন পিকেটিংয়ের অভাবে অনেক স্থানে গাড়ি নেমে পড়েছিল, দোকানপাট খূলেছিল, অফিস-আদালতে কাজ চলছিল। আমাকে যখন পুলিশ সেদিন সকালে পোস্তগোলা থেকে গ্রেপ্তার করে রমনা থানায় নিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেখেছি গাড়ি চলছিল, দোকানপাটও খোলা দেখেছিলাম। কিন্তু একটু পরেই পরিস্থিতি পাল্টে দিল শিল্পাঞ্চলগুলোর শ্রমিকরা, তারা যখন হরতাল করে ঢাকার কেন্দ্রের পথে মিছিল করে আসতে থাকে। আমি থানার লকআপে থেকেও এসব টের পাচ্ছিলাম। পুলিশের ব্যস্ততা দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যায়। তাদের ওয়্যারলেসের কথাবার্তা শুনি। আদমজী জুট মিল থেকে সায়দুল হক সাদুর নেতৃত্বে মিছিল করে ঢাকার যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসে প্রায় পনেরো হাজার শ্রমিক। পুলিশ ও ইপিআরের বিশাল বাহিনী যাত্রাবাড়ীতে তাদের ঢাকায় প্রবেশে বাধা দেয়। শ্রমিকরা সেখানেই অবস্থান করে সারাদিন। পুলিশের অনুরোধের পরও শ্রমিকরা ফিরে যায়নি। তারা জানায় তখনই তারা ফিরে যাবে, যদি সিরাজুল আলম খান তাদের ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। পুলিশ সিরাজুল আলম খানকে পল্টনের আওয়ামী লীগ অফিস থেকে যাত্রাবাড়ীতে নিয়ে আসে শ্রমিকদের বলতে- তারা যেন ফিরে যায়।

আর এই হরতালে অন্যতম প্রধান ভূমিকা নেয় তেজগাঁওয়ের শ্রমিকরা। সেখানকার নেতা ছিলেন রুহুল আমিন ভূঁইয়া। ১৩০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত তেজগাঁও ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন তিনি। তিনি মজদুর ফেডারেশনেরও যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তেজগাঁওয়ে দু’জন শ্রমিক ইপিআরের গুলিতে নিহত হন- মনু মিয়া ও আবুল হোসেন। তেজগাঁওয়ের শ্রমিকরা রেললাইন বন্ধ করে দেয়, ঢাকার মহাখালী, ফার্মগেট সড়কগুলো অবরোধ করে মগবাজার হয়ে রমনা পার্কের দিকে আসে। তেজগাঁওয়ে হরতালের প্রস্তুতে ছাত্রলীগ নেতারা- আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ আরও কয়েকজন রুহুল আমিন ভূঁইয়াকে সাহায্য করেন। তারা তেজগাঁওয়ের শ্রমিকদের মিছিল ঢাকার মগবাজারে নিয়ে আসেন। সাহসী শ্রমিকদের এই ভূমিকাই ছয় দফা আন্দোলনে নতুন গতি দেয়। ৭ জুন হরতালে ঢাকায় তিন-চারশ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। সামারি ট্রায়ালে প্রায় সবার শাস্তি হয়। সেদিনের বন্দিদের মধ্যে আমরা দু’জন ছিলাম ছাত্রলীগের আর দু’জন ছিল ছাত্র ইউনিয়নের। বাকি সব ছিল শ্রমিক বা কিশোর বয়সী ছেলে, যাদের পথ থেকে তুলে আনা হয়েছে। এই বন্দিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী ছিল না।

এর আগে কখনও আওয়ামী লীগের কোনো আন্দোলনে শ্রমিকরা এরকম সংগঠিতরূপে অংশগ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্ম হিসেবে শ্রমিক আন্দোলনে কখনও যুক্ত হয়নি। বরং এর বিরোধিতা ছিল দলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো কোনো সময় শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত বা সমর্থন দিয়ে থাকলেও সাধারণভাবে ধরা হতো এই কাজটা কমিউনিস্টদের।

৭ জুন হরতালকে কেন্দ্র করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ত্রাসের সৃষ্টি করা হয়। শ্রমিক কলোনিতে পুলিশি হামলা চলে। শ্রমিকরা ভয়ে তাদের বাসস্থান বেগুনবাড়ি, নাখালপাড়া ও মহাখালী ছেড়ে পালিয়ে যায়। রুহুল আমিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা হয়। আত্মগোপন অবস্থায় ‘৬৬ সালেই গ্রেপ্তার হন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের পর মুক্তি পান। তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ‘৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে তেজগাঁও থেকে বিশাল বিশাল মিছিল এসে ঢাকা প্রকম্পিত করে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন রুহুল আমিন ভূঁইয়া। মুজিব বাহিনীর প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নেন। নোয়াখালীতে লড়াই করেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাসদের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। জাসদ প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পর পরই তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে রক্ষীবাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে রমনা থানায় নিয়ে আসে। তেজগাঁওয়ের হাজার হাজার শ্রমিক থানা থেকে তাকে মুক্ত করে। ‘৭৩ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। তার ইউনিয়নগুলো তছনছ হয়। তার সমর্থক কয়েকশ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয় ও তেজগাঁও থেকে বিতাড়িত করা হয়। বিতাড়িতদের অধিকাংশই ছিল মুক্তিযুদ্ধে ও ‘৬৬ থেকে ‘৬৯-এর গণআন্দোলনে অংশগ্রহণকারী। রুহুল আমিন দীর্ঘদিন জেলে থেকে ‘৭৮ সালে মুক্তি পান। জাতীয় শ্রমিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ গঠনে উদ্যোগী হন। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন জেলে থাকার সময়, থাইরয়েড গ্ল্যান্ড ফুলে উঠেছিল, টিউমার দেখা দিয়েছিল গায়ে, আবার চলেও গিয়েছিল। কারাগারে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর উপায় ছিল না। দীর্ঘ পাঁচ বছর জেলে কাটিয়ে এসে জীবন-জীবিকা, রাজনীতি ও শ্রমিক আন্দোলনের কাজ করতে গিয়ে তার চিকিৎসার কাজটি ভালোভাবে করতে পারেননি। ছিল আর্থিক সংকটও। তার এক অনুজসম গুণগ্রাহী তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। এই সাহসী শ্রমিক নেতা মারা যান ‘৮৫ সালে। পঞ্চাশের কোঠা তখনও তার পেরোয়নি। তার শ্রমিক আন্দোলন জীবনের অর্ধেকটাই কারাগারেই কাটান। কোনো নিজের প্রাপ্তির জন্য নয়, সারাজীবন লড়াই করেছেন মানুষের জন্য।

লেখক , মেসবাহউদ্দিন আহমেদ

জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি ।