সাম্প্রতিক সময়ে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অবদান নিয়ে আওয়ামী শিবিরের পক্ষ থেকে বির্তক সৃষ্টি করা হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ আলী সাবেক রাষ্ট্রপ্রতি জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে ‘অতি প্রশংসনীয় ভূমিকা’ রাখেন বলে তার লিখিত বইয়ে উল্লেখ করছেন ।
বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইয়ে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে জিয়াউর রহমানের সাথে তার সাক্ষাৎ ও পরবর্তী ঘটনা লিপিবদ্ধ করছেন । নিচে জিয়াউর রহমানের সাথে ওয়াজেদ মিয়ার সাক্ষাতকারের ঘটনাটি উক্ত বইয়ে ১৯৬ এবং ১৯৭ পৃষ্ঠা হুবাহু তুলে ধরা হলো :
‘ ১৯৭৪ – এর নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের গােড়ার দিকের ঘটনা । ঐ সময় একদিন সকালে অফিসে আসে আমার রংপুর জিলা স্কুলের সহপাঠী মুকিতুর রহমান খােকনের পরলােকগতা একমাত্র বড় বােনের বড় ছেলে ইসকান্দার আলভী মঞ্জু । ১৯৫৬ সালে যখন আমি রংপুর জিলা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম সে সময় মুকিতদের বাসায় আমি প্রায়ই যেতাম এবং সারা দিন গল্প গুজব করে কাটাতাম । মঞ্জুর আম্মা ( নেলী আপা ) , নানা অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ জনাব মকবুলুর রহমান সাহেব ও নানী ( খােকনের আম্মা ) আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন । পরবর্তীতে কতদিন না ওদের রংপুর শহরের ধাপস্থ বাড়ীতে রাত্রি যাপন করেছি ।
মুকিতুর রহমান খােকনের আম্মা আমাকে নিজের ছেলের মতই আদর যত্ন করতেন এবং আমি তাঁকে খালা ’ বলে সম্বােধন করতাম । এইভাবে মুকিতদের পরিবারের সঙ্গে আমার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে যা আজ পর্যন্ত অটুট আছে । মজুও আমাকে নিজের মামার মতই মনে করে এবং আমিও ওকে নিজের ভাগ্রের মত স্নেহ করি । মঞ্জু এত মেধাবী যে , ছােট বেলায় আহ্বা – আম্মাকে হারানাে সত্ত্বেও পরবর্তীতে ভালােভাবে লেখাপড়া করে ১৯৭২ সালে ঢাকা বাের্ডের এস , এস , সি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল ।
১৯৭৪ সালে মঞ্জু ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল এবং একজন আদর্শ ছাত্র হিসেবে তাকে তার হােস্টেলের ক্যাপ্টেন নিযুক্ত করা হয়েছিল । সেদিন মজু আমাকে জানায় যে , এর কিছুদিন আগে তার হােস্টেলের অন্যান্য ছেলেরা এক সন্ধ্যায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দালালী করার অভিযােগে ঐ হােস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্টকে দৈহিকভাবে লাঞ্ছিত করে ।
পরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঐ ঘটনাটি সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে মেঃ জেঃ জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে । অন্যান্যদের সঙ্গে মঞ্জুকে দায়ী করে উক্ত সুপারিনটেন্ডেন্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযােগ করেছিল । মঞ্জু আমাকে জানায় যে , কেবলমাত্র হােস্টেলের ক্যাপ্টেন বলেই তাকে উক্ত ঘটনার জন্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে ।
যাহােক মঞ্জুর ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই পরদিন আমি টেলিফোনে জিয়াউর রহমান সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাঁর ঢাকাস্থ সেনানিবাসের অফিসে যাই । কুশলাদি বিনিময়ের পর আমি ১৯৭১ – এর মার্চ মাসে এবং তৎপরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অতি প্রশংসনীয় ভূমিকার উল্লেখ করে তাঁর কাছ থেকে সে সময়ের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই । তাঁর কথাবার্তার মধ্যে আত্মম্ভরিতা বা অহমিকার কোন চিহ্ন দেখলাম না । তিনি ধীরে ধীরে ও শান্তভাবে আমাকে ১৯৭১ – এর মার্চ মাসের ২৬ তারিখ হতে তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করলেন ।
এর এক পর্যায়ে আমি তাঁকে জানাই যে , ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের দিকে এক বছরের জন্য আমি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানী যাবাে পোস্টে ডক্টরাল গবেষণার কাজে । এইভাবে কথাবার্তায় প্রায় দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হয় । আলাপের শেষে , আমি তাঁকে মজুর ব্যাপারটি সম্পর্কে অবহিত করি । এই সাক্ষাতের পর প্রায় দেড় মাস যাবত জিয়াউর রহমান সাহেবের সঙ্গে আমার কোনরূপ যােগাযােগ বা সাক্ষাৎ হয় নি । ডিসেম্বরের মাঝামাঝি একদিন সকালে বঙ্গবন্ধুকে গণভবনের হেলিপ্যাডে বিদায় জানাতে গিয়ে জিয়া সাহেবের সঙ্গে আমার দু’এক মিনিট কথাবার্তা হয় ।
মঞ্জুর ব্যাপারে আর কোনও খোঁজ না নেয়ায় তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন বলে আমাকে জানালেন । তিনি আমাকে এও জানালেন যে , ঐ ঘটনার জন্য ঐ হােস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্টই দায়ী ছিলেন । অতঃপর ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে আমার ( তৎকালীন ) পশ্চিম জার্মানী যাওয়া চূড়ান্তবাবে নির্ধারিত হয়েছে জেনে জিয়া সাহেব বললেন , “ ডঃ ওয়াজেদ , hats off to you । আমি সর্বান্তকরণে আপনার সর্বাঙ্গীন সাফল্য ও মঙ্গল কামনা করি । ” মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এটাই ছিল আমার শেষ সাক্ষাৎ ‘ ।
লেখক : সাকিব এ চৌধুরী ,চীনে অধ্যয়নরত ছাত্র ।
good analysis