“বাংলাদেশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যে চুক্তি করছে সেখানে লেখা ছিলো এই ডিল চলাকালীন বাংলাদেশ আর কোনো উৎস থেকে ভ্যাকসিন কিনতে পারবে না। ভারত যখন নিজে বিপদগ্রস্থ হইলো সেরাম নিজেও বিপদে পড়লো বাংলাদেশরেও ফেললো। সেরামের চুক্তির শর্ত না ভেঙ্গে বিকল্প উৎস এবং বিকল্প উপায়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ চীন ও রাশিয়া দুই দেশের সঙ্গেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্ল্যান্ট বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেয়। সেটার ফলাফল, এসেসমেন্ট ছিলো এই ফাইলে। এমন তথ্যই একটি সুত্রে প্রকাশিত হয়েছে । ”

তথ্য হিসেবে এগুলো ঠিক না ভুল, সেটা তথ্যদাতাই জানেন। এমন যে কোন কিছু হয়ে থাকলে পূর্ণাঙ্গবাবে তা জানবার অধিকার বাংলাদেশের জনগণের আছে। যদি সত্যি এমন হয়ে থাকে যে (আশা করি তেমন শর্ত নেই) সেরামের সাথে চুক্তিকালীন অন্য কোন উৎস থেকে টিকা আনা যাবে না, এমন শর্তের তাৎপর্য তো ভয়াবহ গভীর। বলা যায় এটা মহামারীর মুখে দেশোদ্রোহীতা তুল্য হবে। বিপদের সময়ে সেরাম টিকা দিতে পারেনি, সেটা একটা চুক্তিভঙ্গ। কিন্তু সে চাহিদা না মেটাতে পারলেও অন্য কোন উৎস সন্ধান করা যাবে না, এমন চুক্তি তো অবিলম্বে জনগণের জানা উচিত। বিশেষজ্ঞদের কাটাছেড়া করা উচিত। এবং এমন বাধানিষেষ সম্বলিত চুক্তির দুই আনা দাম কোন আন্তর্জাতিক আদালত দিবে না, ভারতের আদালতও দিবে না, সেটা আইন পাঠের অভিজ্ঞতা আছে এমন যে কেউ বুঝবেন। বরং জনগণের নিরাপত্তা, সরকারের বেপরোয়াপনা ও বেঈমানী। সেরাম নিজেই তো বিপদের সময়ে টিকা না দিতে পেরে আরও গভীর শর্ত ভঙ্গ করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়াবে এইটুকুই: কেবল মাত্র আমদানিকারকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার এমন একটা চুক্তি করবে, যেটা গোটা জনগণকে নিয়ে ফাটকাবাজারি হবে মহামারীর সময়ে! এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমার বিশ্বাস হয় না এমন কোন চুক্তি হয়েছে।

এমন তথ্য যদি রোজিনা ইসলাম উদঘাটন করেও থাকেন, সেটাতে সেরামের নতুন বা বাড়তি বিপদের কোন কারণ নাই। চীন রাশিয়ার সাথে আলাপ বন্ধের কোন কারণ নাই। সেরাম ইতিমধ্যেই যে চুক্তিভঙ্গ করেছে, সেই চুক্তি বাংলাদেশ সরকার কার্যকর করার জন্য আইনী পথ নেবে কি না, তার সাথে এই চুক্তি ফাঁস হবার কোন সম্পর্ক নাই। ওই একচেটিয়া বিক্রির শর্ত আছে কি না, সেই তথ্য ছাড়া এই সব দুই টাকা দামের বাকি যে তথ্য, তা ফাঁস হয়ে যাওয়াতে চীন বা রাশিয়ার সাথে চুক্তি বা আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত হবারও কোন কারণ নেই। আসলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই সব তথ্যের সাথে চীন-জাপান-কোরিয়া-কঙ্গো-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-ফিজি কিংবা ভ্যাটিকান সিটির কোন দূরতম সম্পর্ক নেই, এইটা একটা কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষই বোঝেন।

এই তথ্যগুলোর একমাত্র সম্পর্ক হলো রাষ্ট্রের সাথে জনগনের সম্পর্কের। যে কোন পরিস্থিতিতে সেরামের সাথে, চীনের সাথে, রাশিয়ার সাথে সকল চুক্তি জনগণের নজরদারির ভেতরেই হতে হবে, তার শর্তগুলো বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা দেখবেন, অর্থনীতিবিদরা, আইনবিদরা দেখবেন, এবং অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দেখবেন, এর অন্যথা হতে পারে না।

এই নানান বর্ণের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বাইরে রোজিনা ইসলাম যা ইতিমধ্যে বাস্তবে সম্পন্ন করেছেন, সেগুলোই যথেষ্ট তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের বহু মানুষকে প্রতিহিংসা পরায়ন করবার জন্য। বাস্তবে সেগুলোই নিশ্চিতভাবে ঘটেছে। এই ঘটনার বাড়াবাড়ির যখন ঘটেই গেছে, তখন এই আমলাতন্ত্র ও অন্যান্য চক্রগুলো এবারে নিজেদের মুখরক্ষার জন্য, এবং একইসাথে ভবিষ্যতের রোজিনা ইসলামের মত তুখোড় সাহসী গণমাধ্যমকর্মীদের নিরুৎসাহিত, আতঙ্কিত এবং দাঁত-নখহীন সাংবাদিকে পরিণত করবার জন্য বিনা প্রমাণে রোজিনা ইসলামের কাজের নানান আন্তর্জাতিক তাৎপর্য খুঁজে বের করছে।

এই সব পরিস্থিতিতে উত্তেজিত উতলা না হয়ে সুস্থির হয়ে ভাবুন। অজ্ঞাতস্থানের নানান ষড়যন্ত্রের বাইরেও আপনার হাতে চলবার মত, সিদ্ধান্ত নেয়ার মত, পক্ষ নেয়ার মত যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত আছে। ভাবুন:

১. বাংলাদেশের দুর্নীতবাজ স্বাস্থ্যখাতের কাছে প্রধান শত্রু কে?
২. শাহেদ-সাব্রিনার মত ভয়াবহ সব দুর্নীতির সংবাদ কে ফাঁস করেছে বলে চক্রগুলো তার বিরুদ্ধে তৎপর থাকার কথা?
৩. কোন চুক্তিতে কি কি ক্ষতিকর ধারা আছে, কত টাকা কোথায় ক্ষতি হলো, সেই সত্যগুলো কিভাবে আমাদের হাতে এসেছে?
৪. ভালো হোক, মন্দ হোক, প্রতিরক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক গোপনীয়তা ছাড়া কোন চুক্তি কী জনগণের আড়ালে করা উচিত?
৫.দুদক-মন্ত্রনালয়-পুলিশ ইত্যাদি সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা কি কোন ভয়াবহ চক্রের দুর্নীতি উদঘাটন বা প্রকাশ করতে পেরেছে?

ডানে বামে ষড়যন্ত্রের গন্ধ উতলা হয়ে অস্থির হবেন না, রোজিনা ইসলামের পক্ষ সমর্থন মূহুর্তের জন্য বন্ধ করবেন না। যা যা আমরা ইতিমধ্যে জানি, তাই যথেষ্ট আমাদের অব্সথান ঠিক করবার জন্য। রোজিনার সাথে দেশবাসীর একাত্মতা হাজার রোজিনার জন্ম দেবে। রোজিনার খারাপ কিছু হলে সাংবাদিকতা আরও বহুধাপ নেমে যাবে।

প্রথম আলো, ডেইলী স্টার কিংবা যে কোন গণমাধ্যমের সমালোচনার আজস্র সময় পাবেন, আমরাও পাই। এখনকার প্রশ্ন হলো গণমাধ্যম কর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে পারবেন কি না। সেই অধিকার রোজিনার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হচ্ছে না-কি আরেকধাপ নিচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু এইটা ঠেকানো না গেলে আমাদের সকলের দশাই গণমাধ্যমের সাথে খারাপ হবে। এটা ঠেকানো গেলে, গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীনতা, আইনী অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে আমাদের তথ্য জানার অধিকারই একধাপ বাড়বে। সেটা আমাদের সকলের জন্য ভালো হবে। এখনকার দ্বন্দ্ব জনগণের সাথে গণমাধ্যমের না, এখনকার দ্বন্দ্ব জনগণের তথ্যের অধিকার নিয়ে সরকারের সাথে।

চীন বা রাশিয়া থেকে টিকা আনতে কেন দেরি হচ্ছে সে বিষয়ে রোজিনা ইসলাম কাণ্ডের আগেই কথা বলেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। সেটাও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির কারণেই। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণীর কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে চীন ও রাশিয়ার সাথে টিকাচুক্তি বিলম্বিত হচ্ছে।। এখানে সাংবাদিক রোজিনার দোষ খুঁজে লাভ কি?

আহমেদ ফজলুর রহমান মুরাদ ,  লেখক এবং     রাজনৈতিক বিশ্লেষক     ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading