মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীতে বালুবোঝাই বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের ধাক্কায় নিহত মা-বাবা ও বোনদের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ছোট্ট মীম।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে খুলনার তেরখাদা উপজেলা সদরের পারোখালী গ্রামে পৌঁছায় সে। পরিবারের লাশ নিয়ে ১০ বছরের মীম যখন বাড়িতে ঢোকে, পুরো বাড়িকে শোকের মাতম শুরু হয়। তাদের দেখতে ছুটে আসেন পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন।

আজ মঙ্গলবার সকালে মীমের বাবা-মা ও দুই বোনকে দাফন করার কথা ছিল। এসব তথ্য জানান তেরখাদা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এফএম অহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, মাদারীপুরের শিবচরের ঘটনাস্থল থেকে মীমের বাবা-মা বোনদের মরদেহগুলো তেরখাদায় আনা হয়। পারোখালী গ্রামের বাসিন্দা মনির শিকদারসহ পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় অনেক আত্মীয়-স্বজন এখনো এসে পৌঁছালে মরদেহ দাফন করা হবে।

মনির শিকদারের বেয়াই কিসমত হাওলাদার জানান, ৪ ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন মনির শিকদার। ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাদের।

মনির শিকদারের ভাই কামরুজ্জামান জানান, রোববার রাতে মা লাইলী বেগম (৯০) বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে শুক্রবার নারায়ণগঞ্জ থেকে ওয়াল্টনের শো-রুম বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি ফেরেন কামরুজ্জামান। রোববার রাতে সাহরি সেরে ঢাকা থেকে তেরখাদায় বাড়ির উদ্দেশে তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ফিরছিলেন মনির শিকদার। পদ্মা নদীর শিবচর এলাকায় পৌঁছে মনির শিকদারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার ভাতিজা মিরাজ শিকদারের। সেখানে শেষ কথা হয়েছিল তাদের। মিরাজ তার নানিকে নিয়ে আগের স্পিডবোটে পদ্মা পেরিয়ে তেরখাদায় এসেছিল। পরে জানা গেল-মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় পদ্মা নদীতে একটি বালুভর্তি বাল্কহেডের সঙ্গে যাত্রীবাহী স্পিডবোটের সংঘর্ষে তার ভাই-ভাবী হেনা বেগম, তাদের মেয়ে সুমি আক্তার (৭), রুমি আক্তার (৪) মারা যান। তাদের মরদেহ পারিবারিক কবরস্থান তার মায়ের পাশে সারিবদ্ধ করে দাফন করা হবে বলেও তিনি জানান।

গতকাল শিবচরে পদ্মা নদীতে ঘটনা দুর্ঘটনার পর উদ্ধার লাশের মধ্য থেকে নিজের মা-বাবা ও বোনদের লাশ চিনিয়ে দেয় মীম। এ সময় চিৎকার করে কাঁদছিল সে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা মীমকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তারাও আবেগঘন হয়ে পড়েন।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মীমের বাড়ি খুলনার তেরখাদা উপজেলায়। বাবা-মা ও দুই বোনসহ ঢাকায় থাকত তার পরিবার। গতকাল রোববার তার দাদির মৃত্যুর সংবাদে ঢাকা থেকে মীমের পরিবার বাড়িতে ফিরছিল। পথে পদ্মা নদীতে দুর্ঘটনায় মীম ছাড়াই সবাই মারা যায়। মীমের বাবা ঢাকায় টেইলার্সের কাজ ও টিউশনি করে সংসার চালাতেন।’

ইউএনও বলেন, ‘দুর্ঘটনায় স্পিডবোটটি উল্টে গেলে সঙ্গে থাকা ব্যাগটি ধরেছিল শিশু মীম। সেই ব্যাগটি বুকে ধরে কোনোমতে সে পাড়ে আসে। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে। তাকে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।’

মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মীম একটু স্বাভাবিক হলে তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, তার বাড়ি খুলনার তেরখাদায়। তাৎক্ষণিকভাবে সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে তার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু ওই পরিবারের সক্ষম কেউ ছিল না, যারা লাশগুলো গ্রহণ করবে। পরে আমরাই দায়িত্ব নিয়ে লাশ চারটি দুজনের তত্ত্বাবধানে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ২০ হাজার টাকা করে মোট ৮০ হাজার টাকা সরকারি ব্যবস্থাপনায় দাফনের জন্য দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘মীমের ঘটনাটি আলাদা। কারণ ওর দাদা-দাদি জীবিত নেই। চাচাদের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো ছিল না। যার কারণে তারা ঢাকায় বাস করছিলেন। ওর নানা-নানিই এখন বেঁচে থাকার অবলম্বন। পরিবারের কেউ নেই।’ এ সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading